* অভিজিৎ ঘোষ*
—————————

* ত্রিপুরা বারবার তৃণমূলের উর্বর ভূমি।

* “বিশ্বাস ঘাতকরাই” ঘাসফুলকে বারবার করেছে মলিন।

* ২১-এও সক্রিয় ঘাতক বাহিনী।

* বীজ বোনার আগেই ঘাসফুল “কাঁকড়া সংস্কৃতিক”র আবির্ভাব।

* কড়া নজর রাখতে হবে অভিষেককে।


১৯৯৮ থেকে ২০২১। দীর্ঘ ২৩ বছর। এই সময়ে হাওড়া-গোমতী দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল।রাজ্য রাজনীতিতে হয়েছে উতাল-পাতাল। একের পর এক রেকর্ড গড়েছিলো পূর্বতন বাম সরকার। তবে ২০১৮-তে ঐতিহাসিক পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় বামেদের।রাজ্য রাজনীতিতে উত্থান ঘটেছিলো নবশক্তি বিজেপি’র।
সিপিআইএম, কংগ্রেস ও বিজেপি’র সঙ্গে রাজ্য রাজনীতির অলিন্দে বারবার ঘুরপাক খেয়েছিলো তৃণমূল কংগ্রেস।কিন্তু কোনো কালেই জমি ধরতে পারেনি। ১৯৯৮ সালে রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুধীররঞ্জন মজুমদারের হাত ধরে তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিপুরার মাটিতে প্রথম বীজ বপন করেছিলো।শুরুতেই তৎকালীন সময়ে রাজ্যের দাপুটে বিরোধী দল কংগ্রেসের একটা অংশকে ভেঙে মাথাচাড়া দিয়েছিলো তৃণমূল। কংগ্রেসের প্রথম সারির বড় অংশের নেতারা চলে এসেছিলেন তৃণমূলে। তখন মনে হয়েছিলো কংগ্রেসকে পেছনে ফেলে রাজ্য রাজনীতির দ্বিতীয় শক্তি হয়ে উঠবে তৃণমূল কংগ্রেস।
তৎকালীন জোয়ারের সময়ই আগরতলা পুরসভাতেও শোভাবর্ধন করেছিল তৃণমূলের কাউন্সিলরা।তারা মূলত কংগ্রেসেই ছিলেন।কিন্তু দল পরিবর্তন করে তৃণমূলে চলে আসতে তারা ঘাসফুলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃণমূল কংগ্রেস রাশ নিজেদের হাতে ধরে রাখতে পারেনি। সুধীর রঞ্জন মজুমদার সহ বর্তমান বিজেপি বিধায়ক আশীষ সাহা,রতন চক্রবর্তী সহ প্রথম সারির নেতারা ফের চলে গিয়েছিলেন কংগ্রেসে।তারপরই তৃণমূলের সংগঠনও “তৃণ” হয়ে যায়।রাজনীতিকরা বলছেন,সেই সময় বেশ কিছু নেতা তৃণমূলের সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলো।এই কারণেই রাজ্যে উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি।
পরবর্তী সময়ে বিজেপির বর্তমান বিধায়ক অরুণ চন্দ্র ভৌমিক, মানিক দেব,দুলাল দাসের মত নেতারা তৃণমূল কংগ্রেসের ব্যাটন ধরে রেখেছিলেন দীর্ঘদিন। জন সমর্থনও খারাপ ছিলো না। রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনগুলিতেও তৃণমূল কংগ্রেস মেলেছিলো ডালপালা।কিন্তু রাজ্য নেতৃত্বের লাগাম ছাড়া মনোভাব এবং বঙ্গ উদাসীনতার নার্সিংয়ের অভাবে তৃণমূল তৃতীয় শক্তি(সিপিআইএম ও কংগ্রেসের পর) হয়ে থাকে। রাজনীতিকদের দাবি, আইনজীবী অরুণ চন্দ্র ভৌমিকই এই রাজ্যের সবচেয়ে পুরানো তৃণমূল নেতা। হাতে গুনা চার-পাঁচ জন জুনিয়র আইনজীবীকে নিয়ে তিনি রাজপথে তৃণমূলের সমর্থনে বহু মিছিল করেছেন।

এক সময় রাজ্য কংগ্রেসে প্রবল ভাবে শুরু হয় রক্ত ক্ষরণ।দাপট বাড়ে বর্মন শিবিরের।ক্ষোভে জ্বালা-যন্ত্রনায় কংগ্রেসের তৎকালীন দুই বর্ষীয়ান নেতা রতন চক্রবর্তী ও সুরজিৎ দত্ত(বর্তমানে দুই জনই বিজেপি’র বিধায়ক)যোগ দেন তৃণমূল কংগ্রেসে।বঙ্গ নেতৃত্ব আশা নিয়ে রতন চক্রবর্তীকে দলের চেয়ারম্যান এবং সুরজিৎ দত্তকে দলের সভাপতির দায়িত্ব দিয়েছিলো। বর্ষীয়ান দুই নেতা রতন চক্রবর্তী ও সুরজিৎ দত্তের জামানায় প্রদেশ তৃণমূলকে দূরবীন দিয়ে খোঁজে পাওয়া কষ্টকর ছিলো। এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল আছে কিনা তাও মানুষ বুঝতে পারেনি। তখনও রতন চক্রবর্তী,সুরজিৎ দত্তের মত নেতাদের অভিযোগ ছিলো, “বঙ্গ নেতৃত্বের উদাসীনতার জন্যই তারা কিছু করতে পারছে না”। রাজনীতির বিশারদরা বলছেন, দুই নেতার এই বক্তব্য সত্যি নয়।কারণ তারা নিজেদের রাজনীতির ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই মূলত মমতার দলের ব্যাটন ধরেছিলেন।কাজের কাজ কিছুই করে নি।বঙ্গ থেকে আসা টাকা-পয়সা দলের জন্য খরচ না করে রেখে দিয়েছিলেন নিজেদের ভান্ডে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে বললে মমতার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের লোকসভা আসনে প্রার্থী দিয়েছিলো তৃনমূল।পশ্চিম আসনে রতন চক্রবর্তী এবং পূর্ব আসনে ভৃগুরাম রিয়াং ছিলেন টিএমসি’র প্রার্থী। নির্বাচনে জয়ের জন্য সাংগঠনিক ভাবে কোনো কাজই করেনি রতন-সুরজিতের তৃণমূল।পশ্চিম আসনে তৃণমূলের কোনো পতাকা-পোস্টারই ছিল না। তৎকালীন সময়ে রতন-সুরজিৎ’রা আর্থিক অনটনের কথা বলেছিলেন।অর্থাৎ টাকার অভাবে তারা ভালো ভাবে প্রচার করতে পারছেন না। কিন্তু তৃণমূলের বঙ্গ নেতৃত্বের দাবি,২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের দুইটি আসনের জন্য এক কোটি ২০লক্ষ টাকা দেওয়া হয়েছিলো দলের দুই প্রার্থীকে।রতন চক্রবর্তীর জন্য ৬০লক্ষ টাকা।অনুরূপ টাকা দেওয়া হয়েছিলো ভৃগুরামকে।
বঙ্গ তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ,রতন চক্রবর্তী মাত্র পাঁচ লক্ষ টাকায় খরচ করেছিলেন। তাঁর কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল তৃণমূলের তৎকালীন নেতা সব্যসাচী দত্ত।বর্তমানে তিনি বিজেপিতে।
বাদবাকি ৪৫ লক্ষ টাকা নিজের ব্যাংক একাউন্টেই রেখে দিয়েছিলেন।তারপরও লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে ভালো ভোট পেয়েছিলেন তিনি।ছিলেন দ্বিতীয় স্থানে।অর্থাৎ ত্রিপুরার মাটিতে তৃণমূলের মাটি যে বরাবরই উর্বর তার প্রমান ১৪-র লোকসভা ভোট।অন্যদিকে পূর্ব আসনের প্রার্থী সৎ ব্যক্তি ভৃগুরাম রিয়াং টাকা তুলে দিয়েছিলেন তার কাছের অনুগামীদের কাছে।কিন্তু তারা টাকা খরচ না করে রেখে দেন পকেটে।অর্থাৎ আবারও বিশ্বাস ঘাতকতা শিকার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।একমাত্র ভৃগুরাম রিয়াং দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে টাকা খরচের হিসাব দিয়েছিলেন।রতন চক্রবর্তী তাও করেননি।দাবি টিএমসির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের পরেই কংগ্রেসের সংসার ত্যাগ করে তৃণমূলে যোগ দেন সুদীপ রায় বর্মন সহ আরো কয়েকজন বিধায়ক।তখন স্ক্রিনের বাইরে চলে যান সুরজিৎ-রতন। সুদীপের হাত ধরে ফুলেফেঁপে উঠে তৃণমূল।বিধানসভার বাইরে-ভিতরে জোয়ার আসে ঘাসফুলের।কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখতে পারেনি।সুদীপ রায় বর্মন সহ বাকিরা মমতাকে ফাঁকি দিয়ে চলে যান বিজেপি’তে।যেখানে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখছিলেন মমতা,সেই স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। বলা চলে তখনও মমতার সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছিলেন টিএমসির রাজ্য নেতৃত্ব।যদিও নেতাদের বক্তব্য ছিলো, বঙ্গ নেতৃত্ব উদাসীন থাকার কারণেই তারাও পিছিয়ে গিয়েছেন।এবং বিজেপিতে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
২০২১-এ তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় বারের মত ক্ষমতা দখলের পর রাজ্যে ফের জোয়ার এসেছে মা-মাটি মানুষের দলের। বঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের স্লোগান “খেলা হবে” আছড়ে পড়ে ত্রিপুরায়। সমীক্ষা করতে রাজ্যে আসে আইপেকের টিম।পুলিশ তাদের গৃহবন্দী করে। এই ইস্যু কেন্দ্র করে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জীর রাজ্যে আসা। অবশ্যই এর পরের ঘটনা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে চর্বিত চর্বন নিষ্প্রয়োজন।
বর্তমানে রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের জমি শক্ত হচ্ছে।কিন্তু এই পরিস্থিতিতেও দলের মধ্যে শুরু হয়ে গেছে লবিবাজী।স্পস্ট ভাবে বললে কাঁকড়া সাংস্কৃতির আগমন।ইতিমধ্যে স্থানীয় নেতাদের মধ্যে শুরু হয়েছে ইঁদুর দৌড়। বাড়ছে ল্যাং মারামারির প্রবণতা। কর্মী-সমর্থকদের সামনে এক নেতা, অপর নেতার বিরুদ্ধে উগড়ে দিচ্ছে বিষাক্ত রস।তাতে অবশ্যই দলের আটি শক্ত হওয়ার আগে নড়বড় হয়ে যাবে। প্রদেশ কমিটি গঠিত হলে কাঁকড়া সাংস্কৃতির সংক্রমণ আরো যে বাড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জী যদি সতর্ক না হন তাহলে কিন্তু মমতার স্বপ্ন সাকার হবে না। আবারও পূর্বের মতোই ফুলেফেঁপে উঠে ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মত। তাই এখন থেকেই অতীতের অভিজ্ঞতার ঝুলিকে পাথেয় করে প্রতিটি পদক্ষেপ সাবধানে দিয়ে হবে তৃণমূল নেতৃত্বকে।অন্যথায় আবারও বিফলে যাবে নেতৃত্বের সমস্ত পরিশ্রম।এমন আশঙ্কা করছে রাজনীতির বিশারাদরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *