ডেস্ক রিপোর্টার,২নভেম্বর।।
তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।রবিবার তিনি রাজ্যে এসেছেন। করোনা বিধি মেনে আগরতলায় করেছেন জনসভা। এই ‘জনসভা’কে খুঁটি পূজো বলে বিজেপি’র বিসর্জনের ডাক দিয়েছেন।রাজ্যের রাজনীতিকদের কাছে সুবক্তা হিসাবে সুনাম কুড়িয়েছেন। অভিষেকের ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দেওয়া মত বক্তব্য স্পর্শ করেছে একাংশের আমজনতার মনকে। নিঃসন্দেহে এক্ষেত্রে একশতে একশ পেয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।হলফ করে একথা বলছেন রাজনীতির বিশারদরা। তাসত্বেও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই জনসভা ছিলো ত্রুটিপূর্ণ।তার জন্য অভিষেক যেমন দায় এড়াতে পারবেন না দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে,তেমনি সমালোচনার বন্ধনীর মধ্যে থাকতে হচ্ছে প্রদেশ তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্ব সহ তৃণমূলের ভোট কৌশলী সংস্থা “আই-প্যাক”কে।
কেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভা ছিলো ত্রুটিপূর্ণ? এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা দিয়েছেন রাজনীতিকরা।তার সঙ্গে অবশ্যই একমত তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা।অভিষেকের জনসভায় বেশ কিছু বিষয় নজরে এসেছে।এগুলি অবশ্যই প্রদেশ তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য ঋণাত্মক। কেউ কেউ বলছেন, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভায় অপমান করা হয়েছে রাজ্যের জনজাতিদের।গুরুত্ব দেওয়া হয়নি দুর্দিনের সংখ্যালঘুনেতাদের।সঙ্গে দলের একাংশ নিষ্ঠাবান,লড়াকু নেতা-কর্মী-সমর্থকরাও প্রশংসা পায়নি নেতার মুখ থেকে।পরিষ্কার ভাবে বললে,অভিষেকের মঞ্চ থেকে রাজ্যের মানুষের ভাবাবেগ নিয়ে হয়েছে ছিনিমিনি খেলা। বলছে খোদ প্রদেশ তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা।কেন তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ? তার বাস্তব যুক্তি সঙ্গত ব্যাখ্যা অবশ্যই দেওয়া হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
ক) জনসভার ডায়াসে ব্রাত্য জনজাতি নেতৃত্ব:
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনসভার মঞ্চ ছিলো রবীন্দ্র ভবন চত্বরে।স্থানীয় নেতা সুবল ভৌমিক থেকে শুরু করে আশীষ লাল সিংহ, অসম থেকে আগত তৃণমূল নেত্রী সুস্মিতা দেব,বঙ্গ ফেরত বিধায়ক আশীষ দাস, তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেন, নেতা কুণাল ঘোষ,বিজেপি ত্যাগী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় মঞ্চে শোভা বর্ধন করছিলেন।সর্বোপরি অভিষেক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু এই মঞ্চে কেন কোনো জনজাতি নেতাকে দেখা যায়নি? তাহলে কি তৃণমূল কংগ্রেসে কোনো জনজাতি নেতা নেই? নাকি জনজাতিদের ভোটের প্রয়োজন নেই তৃণমূল কংগ্রেসের? এই সংক্রান্ত নানান প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দর মহলের খবর, ছামনুর বাসিন্দা খান্না মারাক।তিনি পূর্বতন কমিটির এসটি সেলের চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি এসেছেন অভিষেকের জনসভায়।কিন্তু তাকে ডায়াসে বাসার কোনো অনুমতি দেয় নি দলীয় নেতৃত্ব।বা তাঁর পরিবর্তে কোনো জনজাতি মুখকে ডায়াসে জায়গা দেওয়া হয়নি। ছামনু থেকে থেকে আসা তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক সঞ্জিব রিয়াং ও বিজয় দেববর্মা অভিষেকের জনসভাস্থলে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করে বলেন,” তৃণমূল কংগ্রেস জনজাতিদের গুরুত্ব দেয়নি।তার প্রমান অভিষেকের মঞ্চে নেই কোনো জনজাতি নেতা। খান্না মারাককে মঞ্চে ওঠার অনুমতি দেয়নি প্রদেশ নেতৃত্ব। অথচ খোদ অভিষেক বলছেন, ভূমিপুত্ররাই হবেন রাজ্য তৃণমূলের মুখ।কিন্তু বক্তব্যের সঙ্গে বাস্তবতা কোথায়?তাহলে কি জনজাতিদের ভোটের প্রয়োজন নেই তৃণমূলের?এই প্রশ্ন তুলেন তৃণমূল কংগ্রেসের দুই জনজাতি সমর্থক।সর্বোপরি জনজাতিদের মধ্য থেকে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে,তাহলে কি জনজাতিদের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো জনপ্রিয়তা নেই?নাকি জনজাতিদের ভোট ব্যতীত মমতার স্বপ্ন সাকার করতে পারবেন তাঁর সেনাপতি ও সেনারা? রাজনীতিকরা বলছেন,এই ক্ষেত্রে রাজ্যের জনজাতি সম্প্রদায়কে চূড়ান্ত অপমান করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।তবে আগামীদিনে এই ধরণের জনসভায় জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি মঞ্চে না রাখলে আখেরে ক্ষতি হবে তৃণমূলের। সুস্মিতা দেব,সুবল ভৌমিকই নাকি খান্না মারাককে অভিষেকের মঞ্চে উঠার অনুমতি দেন নি।গুঞ্জন তৃণমূল কংগ্রেসে।
খ) মঞ্চে গুরুত্বহীন দুর্দিনের সংখ্যালঘু নেতা:
২০১৮-র বিধানসভা নির্বাচনের পর রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সলতে যখন টিম টিম করছিল তখন দলের বাতি যারা জ্বালিয়ে রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম সংখ্যালঘু নেতা মো: জাহির উদ্দীন।তিনি ছিলেন তৃণমূলের সংখ্যালঘু সেলের চেয়ারম্যান।অনেক জারিজুরির পর জাহির উদ্দীনকে অভিষেকের
মঞ্চে জায়গা দেওয়া হয়।কিন্তু তাকে বক্তব্য রাখার সুযোগ দেওয়া হয়নি।বক্তব্য রেখেছেন ইদ্রিস মিয়া নামে আরেক সংখ্যালঘু নেতা।তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দর মহলের খবর, ইদ্রিস দলে নবাগত।অন্য দল থেকে এসেছেন তৃণমূলে।কিন্তু সিনিয়র নেতাকে ব্রাত্য রেখে ইদ্রিস মিয়াকে কেন বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হলো।প্রশ্ন তুলেছেন দলের পুরানো কর্মীরা।
গ) নেতার মুখে ব্রাত্য স্থানীয় আক্রান্ত কর্মীরা:
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষণের সময় সরব হয়েছিলেন বিজেপি’র সন্ত্রাস নিয়ে।তিনি বক্তব্যের মাধ্যমের তুলে ধরেছিলেন সন্ত্রাসের খন্ড চিত্র।অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ত্রিপুরায় এসে আক্রান্ত হয়েছিলেন সুদীপ-জয়া-দেবাংশু’রা। আক্রান্তদের মধ্যে তিনি অসম থেকে আগত সুস্মিতা দেবের নামও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু রাজ্যে মেয়ে শর্মিষ্ঠা, দীপান্বিতা সহ দলের অনেক যুবা কর্মী আক্রান্ত হয়েছিলেন।সম্প্রতি হাওয়াই বাড়িতে আক্রান্ত হয়েছিলো তৃণমূলের দুই কর্মী,আক্রান্তের তালিকায় আছেন আশীষ লাল সিংহ।কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে তাদের নাম শুনা যায়নি।অর্থাৎ অভিষেকের মুখে ব্রাত্য রাজনৈতিক সন্ত্রাস আক্রান্ত রাজ্যের তৃণমূল কর্মীরা।তবে কলকাতায় চিকিৎসারত মামুন খানের কথা বলেছেন তিনি।তার জন্য অবশ্যই অভিষেককে দায়ী করা যাবে না।কারণ এত জনের নাম মনে রাখা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।তবে স্থানীয় নেতৃত্ব বা আই-প্যাক টিম যদি রাজ্যের আক্রান্ত কর্মীদের তালিকা অভিষেককে দিতেন তাহলে নিশ্চয় তিনি বক্তব্যে তুলে ধরছেন।তা না হওয়াতে স্থানীয় কর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে।তাহলে কি বঙ্গ বা অসম থেকে আসা নেতা-কর্মীদের গুরুত্ব বেশি। ব্রাত্যের তালিকায় চলে গেলো রাজ্যের আক্রান্ত কর্মীরা।তাহলে কি অভিষেকের জনসভা শেষে আঘাত লাগতে শুরু করেছে রাজ্যের ভাবাবেগে।
ঘ) গুরুত্বহীন বিধায়ক আশীষ দাস:
তৃণমূলকে চেটেপুটে খেয়ে বঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে গিয়েছিলেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।তার কালো ব্যবসার কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন খোদ মমতা।তিনি এখন এসেছেন তৃণমূল কংগ্রেসে।আগরতলায় এসে আনুষ্ঠানিক ভাবে যোগ দিয়েছেন।রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বক্তৃতা রেখেছেন।কিন্তু বিজেপি থেকে তৃণমূল কংগ্রেসে যাওয়া রাজ্যের বিধায়ক আশীষ দাস জনসভার মঞ্চে ছিলেন গুরুত্বহীন।অভিষেকের মঞ্চে আশীষকে বক্তব্য রাখার কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। বিজেপি’র বিরুদ্ধে আশীষ দাসের লড়াইয়ের(তাঁর কথায়)বিষয়টি প্রকাশ্যে আসা বেশি জরুরী ছিলো বলে মনে করছে স্থানীয় তৃণমূল কর্মীরা।রাজীব বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে গিয়ে নিরাপদে আছেন।কিন্তু আশীষ আছেন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়।তাছাড়া রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে কয়জনই বা জানেন রাজ্যের মানুষ।যদিও রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে মঞ্চে এনে বিজেপিকে অন্য এক বার্তা দিতে চেয়েছেন অভিষেক।দাবি রাজনীতিকদের।
অভিষেকের মঞ্চে কেন এমন তালগোল পাকিয়ে গেল? রাজনীতিকরা বলছেন,রাজ্য রাজনীতির জমিতে চাষাবাদ করতে আসা তৃণমূল কংগ্রেস একটু একটু করে শক্তি সঞ্চয় করছে।গোটা দলকে সাজানোর চেষ্টা করছে অভিষেক-মমতা।কিন্তু দলের বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। ঈর্ষা গ্রাস করছে তাদের।হামাগুড়ি দিতে থাকা একটি দলের নেতারা এখনই আখের গোছানোর প্রতিযোগিতার কাজে মত্ত হয়ে উঠেছেন।প্রত্যেককে এক সূত্রে না গেঁথে নেতারা যে যার মত করে স্বপ্ন দেখছেন ত্রিপুরা জয়ের। স্থানীয় নেতাদের এই দলাদলির কারণে কালিমালিপ্ত হবে গোটা দল।ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে মমতা-অভিষেকের স্বপ্ন। রাজ্য রাজনীতিতে তৃণমূল কংগ্রেসের অতীত ইতিহাস ভালো নয়।এটা সবাই জানে।তাই চর্বিত-চর্বনের প্রয়োজন নেই। অভিষেকের হাতে মানুষ নতুন তৃণমূলকে দেখতে চাইছে।আশা করছে তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্য।কিন্তু প্রদেশ নেতৃত্বের এই “তুঘলকি” সিদ্ধান্ত তৃণমূলকে পিছিয়ে দিতে পারে কয়েক ধাপ। তাই ত্রিপুরা নিয়ে অধিক সতর্ক থাকতে হবে মমতা-অভিষেককে। এই প্রতিবেদন দেখার পর তৃণমূল নেতা-নেত্রী সুবল ভৌমিক-সুস্মিতা দেব-আশীষ লালরা হয়তো বা আবার বলবেন “জনতার মশাল” বিজেপি’র হয়ে কাজ করছে এবং তৃণমূল কংগ্রেসের নেগেটিভ বিষয়গুলি তুলে ধরছে।সম্প্রতি সুবল ভৌমিককে নিয়ে “জনতার মশাল”র তথ্য সমৃদ্ধ খবর প্রকাশের পর টিএমসি’র পক্ষ থেকে নানান গুঞ্জন শুরু হয়েছিলো।”জনতার মশাল”র উদ্দেশ্য হলো ভুলগুলিকে তুলে ধরা।এতে তৃণমূলের কোনো কোনো নেতার গাত্র দাহন শুরু হয় ঠিকই,তাতে জনতার মশাল’র কিছু আসে যায় না। এবং কে কি তকমা দিলো তা নিয়ে ভাবিত নয় “জনতার মশাল”কর্তৃপক্ষ। “জনতার মশাল” চলছে তার নিজস্ব গতিতে।
