আগরতলা,১২অক্টোবর।।
    ত্রিপুরার বর্ণময় সংস্কৃতির বহমান ধারা দেশের কাছে গৌরবের। ত্রিপুরার মানুষ লোকতন্ত্র ও ঐতিহ্যের সুন্দর এক সমন্বয় গড়ে তুলেছেন। এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। বুধবার সন্ধ্যায় আগরতলা টাউনহলে নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু একথা বলেন। উল্লেখ্য, আগরতলা পুরনিগমের পক্ষ থেকে এদিন সন্ধ্যায় টাউনহলে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি বলেন, রাজ্য সফরে এসে আজ দুর্গাবাড়ি চা বাগান পরিদর্শনে গিয়ে সেখানকার শ্রমিকদের সাথে তাঁর কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছেন, তারা সবাই গরীব অংশের মানুষের কল্যাণে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিষেবার সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। রাজ্য সরকার গরীব অংশের মানুষের আর্থসামাজিক মান উন্নয়নে কাজ করছে। এটাই সবকা সাথ সবকা বিকাশের স্লোগানের এক প্রকৃত উদাহরণ। নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহা, উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা, নগরোন্নয়ন মন্ত্রী মনোজ কান্তি দেব এবং মেয়র দীপক মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।
      রাষ্ট্রপতি বলেন, রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর এবারই তাঁর প্রথম ত্রিপুরা সফর। রাজ্য সফরে আন্তরিক স্বাগত জানানোর জন্য তিনি রাজ্যবাসীকে ধন্যবাদ জানান। এবছর ত্রিপুরা পূর্ণরাজ্য হিসেবে ৫০ বছর পূর্ণ করায় তিনি রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, দেশপ্রেম এবং ভারতীয়তার ভাবনা এই রাজ্যে কতটা প্রবল তা অ্যালবার্ট এক্কা পার্কে গেলেই দেখতে পাওয়া যায়। পরমবীরচক্র অ্যালবার্ট এক্কা ১৯৭১ সালের যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ত্রিপুরার মানুষ তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। রাষ্ট্রপতি বলেন, ত্রিপুরার রাজ পরিবার আধুনিকতাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আগরতলা বিমানবন্দরের নাম মহারাজা বীরবিক্রমের নামে নামাঙ্কিত হওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। মহারাজা বীরেন্দ্র কিশোর সংগ্রহালয়ের শিলান্যাস করতে পারায়ও তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। ত্রিপুরার রাজ পরিবারের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আত্মিক সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, শিক্ষা, বিজ্ঞান এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের অগ্রগতিতে ত্রিপুরার রাজ পরিবার উদারভাবে সহযোগিতা করেছে। রাষ্ট্রপতি বলেন, এবছর ত্রিপুরাকে তার শ্রেণীতে সবথেকে স্বচ্ছ রাজ্য হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এ মাসের প্রথমদিকে আমিই এই পুরস্কার প্রদান করেছি। স্বচ্ছতার এই সংস্কৃতি অব্যাহত রাখার জন্য ত্রিপুরাবাসীকে তিনি ধন্যবাদ জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, ত্রিপুরার হজাগিরি লোকনৃত্য এখানকার সমৃদ্ধ লোক সংস্কৃতির উদাহরণ। তিনি থাঙ্গা দার্লং, সত্যরাম রিয়াং এবং বেণীচন্দ্র জমাতিয়ার জাতীয় সম্মান প্রাপ্তির কথাও তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ত্রিপুরার শচীন দেববর্মণ, রাহুল দেববর্মণ ছাড়া ভারতের আধুনিক গানের কথা চিন্তাও করা যায় না।


রাষ্ট্রপতি বলেন, মহিলা স্বশক্তিকরণে ত্রিপুরা দেশের প্রথম দিকের রাজ্যগুলির মধ্যে অন্যতম। এখানকার প্রতিভাশালী ও কর্মঠ মহিলাগণ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। ত্রিপুরার দীপা কর্মকার, লক্ষ্মীতা রিয়াং ক্রীড়া জগতে দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব সুদৃঢ় করতে প্রথম থেকেই ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছে। কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে ত্রিপুরায় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ চলছে। এমনই কয়েকটি প্রকল্পের আজ শিলান্যাস ও উদ্বোধন করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি বলেন, ত্রিপুরা এডুকেশনাল হাব গঠনের ক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত প্রগতি করছে। এখানে উচ্চশিক্ষা এবং পেশাগত শিক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। অন্যান্য রাজ্য থেকেও ছাত্রছাত্রীরা এখানে পড়তে আসছে। আমি মনে করি বিদ্যালয়স্তরে উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থাই প্রকৃত শিক্ষার মূল ভিত্তি। বুনিয়াদি শিক্ষায় একশো শতাংশ এনরোলমেন্ট হওয়ায় তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতি আশা প্রকাশ করেন বর্তমান সরকার রাজ্যের অগ্রগতি অব্যাহত রাখবে।
             নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী প্রফেসর (ডা.) মানিক সাহা বলেন, রাজন্য স্মৃতি বিজড়িত এই শহরে রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে পেরে আমরা আনন্দিত ও গর্বিত। বহু কৃতী ও গুণী মানুষের সান্নিধ্য পেয়েছে এই শহর আগরতলা। রাষ্ট্রপতির শুভ পদার্পণ এই শহরের গৌরবময় ইতিহাসকে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। আমরা আনন্দিত রাষ্ট্রপতির হাত ধরে বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও শিলান্যাস হয়েছে যা রাজ্যের ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। ত্রিপুরাবাসী হিসেবে আজ আমাদের কাছে অত্যন্ত আনন্দের দিন। আপনার সান্নিধ্য এই শহর ও এই রাজ্যের জনগণ পেয়েছে। কঠোর অধ্যবসায়, নিষ্ঠা এবং অদম্য মানসিকতা নিয়ে আপনি দেশের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন, যা দেশের জনগণের সাথে এই রাজ্যের জনগণকেও উদ্বুদ্ধ করবে। আপনার কর্মজীবন, ব্যক্তিত্ব ও দেশপ্রেমিক মানসিকতা নবপ্রজন্মের কাছে নতুন বার্তা বয়ে আনবে। নারী শক্তির ক্ষমতায়নে আপনি আমাদের কাছে এক অন্যতম দৃষ্টান্ত। বিশাল এই দেশের কর্ণধার হিসেবে আপনার বলিষ্ঠ চিন্তা, চেতনা ও মানসিকতা সর্বোপরি বিদগ্ধ পান্ডিত্য দেশের আপামর জনগণকে উদ্বুদ্ধ করবে বলে প্রত্যাশা করি।
          মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ত্রিপুরাবাসী হিসেবে আজ আমরা আনন্দিত ও গর্বিত যে আজ সকালে রাষ্ট্রপতির করকমল স্পর্শে ত্রিপুরা জুডিশিয়াল একাডেমির শুভ উদ্বোধন হয়েছে এবং সেই সঙ্গে ত্রিপুরায় জাতীয় আইন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিলান্যাস করা হয়েছে। আরও খুশি যে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু আজ দুপুরে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী ভবনে এক মহতি অনুষ্ঠানে নবনির্মিত এমএলএ হোস্টেলের উদ্বোধন করা সহ বেশ কিছু নির্মাণ প্রকল্পের ভার্চুয়াল শিলান্যাস করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রপতি আপনি জেনে খুশি হবেন যে, জনজাতিদের উন্নয়নে রাজ্য সরকার বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- উপজাতি কল্যাণ দপ্তরের নাম পরিবর্তন করে জনজাতি কল্যাণ করা হয়েছে, আগরতলা বিমানবন্দরের নাম পরিবর্তন করে মহারাজা বীরবিক্রম মাণিক্যের নামকরণ করা হয়েছে, মহারাজা বীরবিক্রম কিশোর মাণিক্যের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা, টিটিএএডিসির নাম পরিবর্তন করে তিপ্রা টেরিটোরিয়াল কাউন্সিল নামকরণের উদ্যোগ নেওয়া, স্থায়ী পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে শরণার্থীদের।
     অনুষ্ঠানে উপমুখ্যমন্ত্রী যীষ্ণু দেববর্মা বলেন, আজ রাজ্যবাসীর জন্য এক ঐতিহাসিক দিন। ত্রিপুরা ছোট রাজ্য হলেও এর গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে। ইতিহাস বিজড়িত এই রাজ্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাতবার এসেছেন। তিনি বলেন, বর্তমান রাজ্য সরকার রাজ্যের নাগরিক জীবন সুন্দর ও সুরক্ষিত করার জন্য বহু কাজ করেছে। পিছিয়ে পড়া জনজাতি সম্প্রদায়ের কল্যাণেও সরকার নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির জীবন ত্রিপুরা সহ সমস্ত ভারতবাসীর জন্য এক প্রেরণা। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনও জনজাতি মহিলা দেশের সর্বোচ্চ স্থানে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রী সারা বিশ্বকে দেখিয়েছেন যে ভারত যা চিন্তা করে তা করে দেখায়। কোভিড অতিমারীর সময়ে বিভিন্ন দেশকে ভারত ভ্যাকসিন দিয়ে সাহায্য করেছে। ভারতবাসী হিসেবে এরজন্য আমরা গর্বিত। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন আগরতলা পুরনিগমের মেয়র দীপক মজুমদার। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নগরোন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী মনোজ কান্তি দেব।
       অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর হাতে রাজ্যের বাঁশবেতের তৈরি চতুর্দশ দেবতা মন্দিরের প্রতিকৃতি তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। বাঁশবেতের তৈরি ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের প্রতিকৃতি রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেন উপমুখ্যমন্ত্রী ও বশবেতের বিভিন্ন সামগ্রী তুলে দেন নগরোন্নয়ন মন্ত্রী মনোজ কান্তি দেব। এছাড়াও রাষ্ট্রপতির হাতে ত্রিপুরা সিল্কের তৈরি শাড়ি, শাল চাদর তুলে দেন আগরতলা পুরনিগমের মেয়র দীপক মজুমদার। অনুষ্ঠানে আগরতলা পুরনিগমের মেয়র দীপক মজুমদার রাষ্ট্রপতির হাতে নাগরিক সংবর্ধনার মানপত্রও তুলে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *