
ডেস্ক রিপোর্টার ২৪সেপ্টেম্বর।।
বাম জমানার শেষ পর্বে পরপর রাজ্যে খুন হয়েছেন দুই সাংবাদিক শান্তনু ভৌমিক ও সুদীপ দত্ত ভৌমিক। উভয়ের মামলার তদন্ত প্রাথমিক ভাবে রাজ্য পুলিশ করলেও পরবর্তী সময় মামলার তদন্তের দায়িত্ব বর্তায় দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের উপর। সিবিআইয়ের হাতে মামলা ন্যাস্ত হওয়ার পর দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন পর্যন্ত দুই সাংবাদিক খুনের কোনো ঘটনার কিনারা করতে পারেনি দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা। ২৩’র নির্বাচন এক দৌড়গোড়ায়। স্বাভাবিক ভাবেই ভোটের মাইলেজ পেতে একাংশ রাজনীতিবিদ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন দুই সাংবাদিক হত্যা সংক্রান্ত সিবিআইয়ের হাতে ন্যাস্ত হওয়া মামলার তদন্ত নিয়ে। আদৌ সিবিআই দুই সাংবাদিক খুনের মামলার তদন্তের শেষ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে খুন সংক্রান্ত মামলার তদন্তের সাফল্য সিবিআইয়ের ঝুলিতে শূন্যের কোঠায়। বিজেপি নেতা শ্যামহরি শর্মা হত্যাকাণ্ড থেকে এসডিও সুখরাম দেববর্মা হত্যাকাণ্ড, কংগ্রেস বিধায়ক মধুসুধন সাহা হত্যাকাণ্ড থেকে সুদীপ-শান্তনু হত্যাকাণ্ড। আজ পর্যন্ত সবকটি মামলার তদন্তেই হাত পুড়েছে সিবিআইয়ের। আন্তর্জাতিক জাল ড্রাফট মামলার তদন্তেরও একই হাল। তবে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের মেডিক্যাল আসন কেলেঙ্কারি তদন্তে সিবিআইকে অবশ্যই একশো শতাংশ নম্বর দেওয়া যায়। এই মামলার মূল আসামিদের একজন রাজ্যের প্রয়াত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুধীর রঞ্জন মজুমদার। যদি তিনি মামলার রায়ের আগ পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন, তাহলে অবশ্যই তাকে জেলের ঘানি টানতে হতো। কেননা, এই মামলার সঙ্গে জড়িত অন্যান্যদের জেলে পুড়তে সক্ষম হয়েছিলো সিবিআই। খোয়াইয়ে টিএসআর জওয়ানদের হাতে খুন হওয়া এক জনজাতি মহিলার হত্যাকাণ্ডের ঘটনাতেও সিবিআই সাফল্য পেয়েছে। তবে রাজ্যের সিংহভাগ খুনের মামলার ক্ষেত্রে সিবিআইয়ের সাফল্যের গ্রাফ বরাবরই নিম্নমুখী। তার পেছনেও যথেষ্ট বিজ্ঞান সম্মত কারণ রয়েছে। অন্তত অপরাধ বিজ্ঞানীরা এমনটাই বলছেন।

বিজেপি নেতা শ্যামহরি শর্মার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করেছিলো সিবিআই। শেষ পর্যন্ত সিবিআই এই মামলার চার্জশিট দাখিল করতে পারেনি। আদালতে জমা করে চূড়ান্ত রিপোর্ট। গ্রেফতার হয়নি অভিযুক্তরা। সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করলেও উপযুক্ত আলামতের অভাবে তারা বেরিয়ে যায় আইনের মারপ্যাঁচ গলে। এসডিও সুখরাম দেববর্মাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছিলো সমাজদ্রোহীরা। অনেক জল ঘোলা হওয়ার পর সুখরাম দেববর্মার হত্যাকাণ্ডের তদন্ত বর্তে ছিলো সিরিয়াইয়ের হাতে। আজ পর্যন্ত রাজ্যের মানুষকে সিবিআই জানাতে পারেনি এই ঘটনার পেছনে কারা ছিলো। অর্থাৎ এই মামলাও সিবিআইয়ের হিমঘরে তলিয়ে যায়। উপযুক্ত তথ্য প্রমাণ না পেয়ে সিবিআই চার্জশিটের পরিবর্তে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা করে আদালতে। কংগ্রেস বিধায়ক মধুসূধন সাহা ওরফে ভোলা খুনের ঘটনার পরও মামলার তদন্ত দেওয়া হয়েছিলো সিবিআইকে। কিন্তু এই মামলাতেও সিবিআই বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেনি। অন্যান্য মামলাগুলির মতোই আদালতে চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা করে। এই কয়েকটি মামলা থোকে পরিষ্কার রাজ্যে সংঘটিত খুনের মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের সাফল্য কতটা? এই পরিস্থিতিতে রাজ্যের মানুষ আশা করছে সাংবাদিক সুদীপ-শান্তনু খুনের রহস্য উন্মোচন করবে সিবিআই। বাস্তব অর্থে এখন পর্যন্ত সিবিআই দুই সাংবাদিক খুনের মামলার তদন্তে কোনো নতুন দিশা দেখাতে পারবে না বলেই মনে করছে আইন বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ অন্যান্য মামলার মতোই সুদীপ-শান্তনুর মামলাও সিবিআইয়ের হিমঘরে ক্লোজড চাপ্টারে পরিণত হতে চলছে খুব শীঘ্রই। অন্তত মামলার গতি প্রকৃতি তারই ইঙ্গিত করছে।
অপরাধ বিজ্ঞানের প্রাজ্ঞদের বক্তব্য অনুযায়ী, রাজ্যে সংঘটিত খুনের মামলার তদন্তে সিবিআইয়ের সাফল্য শুন্যের কোঠায় থাকার জন্য কোনোভাবেই দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থাকে দায়ী করা যাবে না। কেননা, খুন সংঘটিত হওয়ার পাঁচ-ছয়মাস পর সিবিআইকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তদন্তের। তার আগ পর্যন্ত রাজ্য পুলিশ, সিআইডি বা ক্রাইম ব্রাঞ্চ সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত করে। তারাই সংগ্রহ করে খুন হওয়া জায়গা (place of occurrence) থেকে বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ। সিবিআইয়ের হাতে যখন এই সমস্ত খুনের মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে বহু তথ্য প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায় না। রাজ্যে তদন্তকারী সংস্থা যেসব আলামত সিবিআইে হাতে তুলে দেয়, এইগুলিকে ভিত্তি করেই তদন্ত করে থাকে সিবিআইয়ের আধিকারিকরা। তখন দেখা যায় তদন্তের স্বার্থে বহু তথ্য প্রমাণ তাদের কাছে যথার্থ পরিমাণ থাকে না। তার আগেই কখনো গুরুত্ব পূর্ণ আলামত লোপাট হয়ে যায়। আবার কখনো কালের নিয়ম অনুযারী নষ্ট হয়ে যায় বহু তথ্য। স্বাভাবিক ভাবেই পুলিশের কাছে থাকা তুলনায় কম গুরুত্ব পূর্ণ তথ্য প্রমাণ দিয়ে সিবিআইয়ের পক্ষে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা বা তাদের শাস্তির কাঠগড়ায় ঠেলে দেওয়া সম্ভব হয় না। স্বাভাবিক কারণেই উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের অভাবে “অর্ধ মৃত” মামলা থেকে হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয় সিবিআই।

সাংবাদিক সুদীপ-শান্তনু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। খুন হওয়ার স্থল ( place of occurrence) থেকে ত্রিপুরা পুলিশই সংগ্রহ করেছে তথ্য-প্রমান। সুদীপ দত্ত ভৌমিকের খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে অবশ্যই কিছুটা ব্যতিক্রম রয়েছে। এই ঘটনায় জড়িত টিএসআরের কমানডেন্ট তপন দেববর্মা সহ আরো তিন জওয়ানকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তারা বেশ কিছুদিন জোলেও ছিলো। কিন্তু শান্তনু খুনের ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ শুধুমাত্র সন্দেহভাজন কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। তবে মূল অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছেন আইপিএফটির বিধায়ক ধীরেন্দ্র দেববর্মা। তাকে অবশ্যই জেলে যেতে হয়নি এখন পর্যন্ত। কারণ সিবিআইও এই মামলার তদন্ত চালিয়েছে যাচ্ছে অতন্ত সম্বুক গতিতে।
অপরাধ বিজ্ঞানের ভাষায়, কোনো হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বা এক-দুদিনের মধ্যেই সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তাহলেই সিবিআইয়ের পক্ষে সম্ভব মানলার গভীরে যাওয়া। অন্যথায় পাঁচ-ছয়মাস পর সিবিআইকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়ার কোনো মানেই থাকে না। কেননা, সিবিআইয়ের পক্ষে অকুস্থলে (খুন হওয়ার জায়গায়) গিয়ে আলামত করা সম্ভব থাকে না। তার আগেই বহু তথ্য বিলিন হয়ে যায়। এই কারণেই সিবিআইকে তদন্তে নেমে নাকানি চোবানি খেতে হয়। শেষ পর্যন্ত সিবিআই এক প্রকার বাধ্য হয়ে এই সমস্ত মামলা থেকে হাত গুটিয়ে নেয়।

সুদীপ-শান্তনু দুই সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডের মামলার তদন্তের ক্ষেত্রেও সিবিআইয়ের গতিপথ একই দিকে নির্দেশ করছে। শ্যামহরি শর্মা, মধুসুধন সাহা, সুখরাম দেববর্মাদের মামলার মতোই দুই সাংবাদিক সুদীপ-শান্তনু’ র মামলার তদন্ত সিবিআইয়ের হিমঘরে তলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা শুধু মাত্র। এই মুহূর্তে অবশ্যই ধূসর আশা জাগিয়ে রেখেছে কিছুটা। তবে এই আশা বাস্তবায়িত হবে কিনা তা বলবে ‘সময়’।
আন্তর্জাতি জাল ড্রাফট মামলার তদন্তের ক্ষেত্রেও সিবিআই বিশেষ কিছু করতে পারেনি। রাজ্যের সর্ববৃহৎ চিটফান্ড মামলার তদন্তেও সিবিআই একেবারে অসার। আজ পর্যন্ত রোজভ্যালি চিটফান্ড সংস্থার কর্ণধার গৌতম কুণ্ডকে রাজ্যে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করার মতো অবস্থা তৈরি করতে পারেনি দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থা। অথচ এই রাজ্য থেকে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রোজভ্যালি। কিন্তু আজ পর্যন্ত নির্দিষ্ট করে ত্রিপুরার মামলার প্রেক্ষিতে সিবিআই গৌতম কুতুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাজ্যে আনতে ব্যর্থ। সমস্ত দিক থেকে বিচার বিবেচনা করলে সিবিআইয়ের হাতে ত্রিপুরার ন্যস্ত হওয়া মামলাগুলির তদন্তের হাল একেবারেই বেহাল। সিবিআইয়ের তদন্তের এই কদর্য চেহারার মধ্যে কোনোভাবেই সুদীপ-শান্তনু খুনের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির কাঠগড়ায় পৌঁছাতে পারবে না বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট মহল।

সুতরাং সুদীপ-শান্তনুর খুনিদের গ্রেফতারের আশায় যারাই ফের সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছেন,তাদের নীরবে নিভৃতে থাকা ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই। তবে অবশ্যই বিভিন্ন রাজনীতিকরা এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাজনীতির ময়দান থেকে ফায়দা তুলতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা বোধ করবে না।কারণ রাজনীতিক দলগুলির দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র কয়েকটি ‘ রক্ত মাখা লাশ’।