অভিজিৎ ঘোষ
________________
রাজ্যে বাঙালি ও জনজাতিদের মেলবন্ধনের বহু ইতিহাস রয়েছে। রাজন্য আমলে ত্রিপুরার রাজাদের মন্ত্রীসভার মূল পরামর্শদাতা ছিলেন বাঙালিরা। পাহাড়ি – বাঙালি ভাই – ভাই, সম্প্রীতির এই স্লোগান ছিল রাজ্যের সর্বত্র।দুই সম্প্রদায়ের মানুষের হাত ধরেই পার্বত্য ত্রিপুরার কিরণ ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা দেশ – বিদেশে। কিন্তু এক শ্রেণীর স্বার্থপর মানুষের জন্য পাহাড়ি – বাঙালির সম্প্রীতির মধ্যে ছন্দ পতন ঘটিয়ে দেয়। অবিশ্বাসের বিষ বাষ্প ছড়িয়ে দেয় গোটা রাজ্যে। একে অপরকে শত্রু ভাবতে থাকে। দুই সম্প্রদায়ের মানুষের এই চিন্তা ভাবনা ক্যাশ করেই স্বার্থনেশীরা শকুনের মতো অবিশ্বাসের বিস্টাকে জনজাতিদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে দেয়। আর তাতেই ত্রিপুরার বুকে ডেকে আনে অভিশপ্ত “জুন”। ১৯৮০- র ৬ জুন থেকে ৮ জুন রক্তস্নাত হয়েছিলো গোটা রাজ্য। শেষ দিনেই মান্দাই হয়ে উঠেছিল বাঙালি হত্যার কসাই খানা।

১৯৮০ সালের ৮জুন মান্দাইয়ে বয়ে যায় বাঙালির রক্তে স্রোত। জনজাতি অংশের মানুষ বন্দুক, বর্শা, তলোয়ার, কাস্তে তীর-ধনুক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর।মান্দাইযের এই গণহত্যা ১৯৬৮ সালে ভিয়েতনামের মি লাই-য়ে সংঘটিত হত্যালীলা থেকেও ভয়ানক ছিলো। এই দাবী ছিল, দেশের সুশীল সমাজের। আসাম রাইফেলসের ভাষায় মান্দাই ছিলো “কিলিং গ্রাউন্ড”।

রাজধানী আগরতলা থেকে ৩০ কিলোমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এডিসির একটি গ্রাম মান্দাই।এই গ্রামে ছিলো জাতি – জনজাতি মিশ্র সংস্কৃতির মানুষের বসবাস। ৮০- জুনের প্রথম দিন থেকেই বাঙালি বিতাড়নের নামে হিংসার স্ক্রিপ্ট রচনা করেছিলো জনজাতি সম্প্রদায়ের একাংশ নেতা।এই হিংসার বীজ সাধারণ জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেও বপন করা হয়েছিল খুব মসৃন ভাবে। অন্তত এটাই বলছে ইতিহাস।

ইতিহাসের তথ্য ৮০ – র ৬ জুন থেকে রাজ্যে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়ে যায় হিন্দু বাঙালি নিধন যজ্ঞ। এদিন রাতে জনজাতি ভিত্তিক রাজনৈতিক দল ত্রিপুরা উপজাতি যুব সমিতি ও তৎকালীন জঙ্গি দল টিএনভি নেতারা বাঙালি হিন্দুদের গণহত্যার একটি নীল নকশা তৈরি করেন।রাত থেকেই পরিকল্পিত ভাবে সশস্ত্র জনজাতিরা বাঙালি হিন্দু এলাকাগুলো ঘিরে ফেলে।৭ জুন সকালে, অগ্নিসংযোগ, সহিংসতা ও খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে রাজ্যে।৮ জুন সকাল থেকেই নারকীয় সংহার শুরু হয় জিরানিয়া মহকুমার মান্দাইয়ে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্য বলছে, মন্দাই গণহত্যাকাণ্ডে প্রায় ৩৫০ থেকে ৪০০ হিন্দু বাঙালিকে হত্যা করা হয়। আক্রমণকারীরা ছিলো জনজাতি সম্প্রদায়ের।
নর পিচাশরা বাঙালি অংশের মানুষের মাথা কেটে ফেলে এবং তাদের অঙ্গগুলি ছিন্নভিন্ন করে দেয়। বাদ যায়নি শিশু ও মহিলারা।

অন্তঃস্বত্তা মহিলাদের উপরও চালানোর হয়েছিলো অত্যাচার। এই গণহত্যার বর্ণনা যতটা কম দেওয়া যায় ততটাই ভালো। রাজ্যের ইতিহাসে এই অভিশপ্ত দিন আর কেউ দেখতে চায় না। এই দিনের প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে সুদীর্ঘ ৪৪বছর পরও নাড়া দেয় লাশের মিছিলের ভয়ানক ছবি। আজও তারা ভুলতে পারেন নি। স্বপ্নে তাড়া করে ৮- জুনের রক্তস্নাত মন্দাইয়ের ঘটনা।

কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক মান্দাই গণহত্যার তদন্তের জন্য দিনেশ সিং কমিটি গঠন করেছিলো।এই কমিটি তদন্ত শেষ করে রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট দিয়েছে কিনা, আজও কাউর জানা নেই। বা রিপোর্ট দিলেও সরকার হত্যাকারী বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কিনা আজও জানতে পারেনি রাজ্যের মানুষ।

কার স্বার্থে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট চাপা দিয়ে রেখেছিল তৎকালীন রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট সরকার? বা তদানীন্তন কেন্দ্রীয় সরকার-ই বা করেছে? পরবর্তীতে রাজ্যের ক্ষমতায় এসেছিলো ৮৮- কংগ্রেস টিইউজেএস জোট সরকার। তখনও দীনেশ সিংয়ের রিপোর্ট নিয়ে মাথা ঘামায় নি সরকার। হালে রাজ্যের মসনদে ভারতীয় জনতা পার্টি।কিন্তু কোথায় দাঙ্গার দীনেশ সিংয়ের রিপোর্ট নিয়ে কথা বলার জু নেই বিজেপি লিড সরকারের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাদেরও।আজও উঠছে সেই প্রশ্ন।

রাজ্যের মানুষ ৮০- র ৬ থেকে ৮ জুনের রক্তস্নাত ত্রিপুরা আর চায় না।মানুষ ভুলতে চায়। জাতি – জনজাতি উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ হাতে হাত মিলিয়ে ত্রিপুরাকে এগিয়ে নিতে চায়। গোটা জুন মাসকে সম্প্রীতির মাস হিসাবে উদযাপন করার জন্য দাবি উঠছে সাধারণ মানুষের পক্ষ থেকে। তা সত্বেও আজকের দিনেও স্বার্থনেশিরা বাঙালি বিতারনের ভুয়ো স্বপ্ন দেখিয়ে ত্রিপুরার শান্তির পরিবেশকে বিনষ্ট করতে চাইছে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল।