সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসব মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে শুরু হয়েছে রবিবার।শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মঙ্গল সংগীতে দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেয় হিন্দু ধর্মাম্বলী ভক্তরা। ইতোমধ্যে শারদীয় দুর্গোৎসবের সব ধরণের প্রস্তুতি শেষ করেছেন আয়োজকরা। মন্দিরে মন্দিরে দেবী দূর্গা প্রতিমা। পূজামন্ডপে প্যান্ডেল থেকে শুরু করে লাইটিং ও শিল্পীদের সাজসজ্জা শেষ। শনিবার ছিল মায়ের বোধন ।এদিন সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমেই দক্ষিণায়নের নিদ্রিত দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙার জন্য বন্দনাপূজা করা হয়। বোধন দুর্গাপূজার অন্যতম আচার। বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ বা চৈতন্যপ্রাপ্ত। পূজা শুরুর আগে সন্ধ্যায় বেলশাখায় দেবীর বোধন দুর্গাপূজার একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। পুরান মতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্ত কালে তিনি এই পূজা আয়োজন করেছিলেন বলে এ পূজাকে বাসন্তী পূজা বলা হয়। কিন্তু রাজা দশরথের পুত্র রাম চন্দ্র তাঁর স্ত্রী দেবী সীতাকে আশুর রাজ রাবণের হাত থেকে উদ্ধার করতে শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন।
রবিবার মহাষষ্ঠীতে দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়।
তাই শরৎকালের এই পূজাকে অকাল বোধনও বলা হয়। তবে বসন্তকালে চৈত্র মাসে যে দুর্গাপূজা তথা বাসন্তীপূজা হয়, তাতে বোধন করার প্রয়োজন হয় না। প্রতি বছর বিভিন্ন বাহনে স্বপরিবারে শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে দেবী মর্ত্যলোকে আসেন বাপের বাড়ি বেড়াতে। তাই দেবীকে বরণে আয়োজনের কমতি নেই। রবিবার মহাষষ্ঠীতে দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হয়। ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা ও পূজার আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃরূপে দেবী দুর্গা অধিষ্ঠিত হবেন মণ্ডপে মণ্ডপে। দেবী দুর্গার আগমনে উচ্ছসিত ভক্তকূল। সারাদেশে এখন চলছে উৎসবের আমেজ। ইতোমধ্যে সারাদেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মণ্ডপে পূজার প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। সরকার ও প্রশাসনের পক্ষ থেকেও পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি।
কাদামাটির প্রলেপের ওপর রং-তুলির আঁচড়ে দশভুজা দেবী ষষ্ঠীর দিন পেয়েছে জীবন্ত রূপ।
রাজধানীর পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপরই তৈরি হয়েছে একাধিক মণ্ডপ। রাজধানী ঢাকা সহ সারাদেশের মন্দির ও পূজামণ্ডপগুলোতে ধর্মীয় নানান আচার-অনুষ্ঠানের সব ধরণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। চণ্ডীপাঠ ছাড়াও ঢাক-কাঁসর ও শঙ্খ বাজিয়ে দেবী দূর্গাকে করা হয় আরাধনা। মণ্ডপে মণ্ডপে শোনা যায় পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরুপেন সংস্থিতা-নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমোঃ নমোঃ’ মন্ত্র উচ্চারণ।
শ্রী ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন, স্বামীবাগের লোকনাথ মন্দির, রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম, সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দির, মিরপুর কেন্দ্রীয় মন্দির, সিদ্ধেশ্বরী পূজামণ্ডপ এবং খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে সনাতন সমাজকল্যাণ সংঘের পূজামণ্ডপসহ রাজধানীর অন্য মন্দির ও মণ্ডপগুলোতে এখন উৎসবের আমেজ। সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় পূজার মাধ্যমে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবীতে) আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবার মা দুর্গা গজে (হাতি) চড়ে স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে এসেছেন (আগমন)। যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে। দেবী স্বর্গালোকে বিদায় (গমন) নেবেন দোলায় (পালকি) চড়ে; যার ফল হচ্ছে মড়ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই ৫দিনব্যাপী পূজা শুরু হয়ে গিয়েছে।
শাস্ত্রকারদের মতে, দুর্গা ভক্তদের বাধাবিঘ্ন, ভয়, দুঃখ, শোক, জ্বালা ও যন্ত্রণা থেকে রক্ষা করেন। আরেক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, দুঃখের দ্বারা যাকে লাভ করা যায় তিনিই দুর্গা। দেবী দুঃখ দিয়ে মানুষের সহ্যক্ষমতা পরীক্ষা করেন এবং তখন ভক্তরা তাকে ডাকলে তিনি কষ্ট দূর করেন। বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর বলেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ঢাকা মহানগরে এবার ২৫৯টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর ঢাকা মহানগরে ২৫২টি পূজার আয়োজন হয়েছিল। সে হিসেবে মহানগরে ৭টি পূজা বেড়েছে। সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর ৩১ হাজার ৪৬১টি পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। সরকারের নির্দেশনায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিটি পূজামণ্ডপের নিরাপত্তায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি প্রতিটি মন্ডপে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগীতার আশ্বাস দিয়েছেন সেনাপ্রধান। ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সার্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। এদিকে, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের পূজামণ্ডপের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ৪৩০ প্লাটুন সদস্য। পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পাশাপাশি প্রায় ৩ লাখ আনসার সদস্য এবং নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ৮০ হাজার স্বেচ্ছাসেবক সারাদেশের পূজামণ্ডপে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকবেন।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি। এর সফল বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।
অপরদিকে, শনিবার শারদীয় দূর্গাপূজা উপলক্ষে দেওয়া এক বাণীতে উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যে অগ্রযাত্রা শুরু করেছি। এর সফল বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। সব অশুভ, অন্যায় আর অন্ধকারকে পরাজিত করে শুভ চেতনার জয় হবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে-দূর্গাপূজা উপলক্ষে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি। শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান প্রধান উপদেষ্টা। সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গাপূজা। হিন্দু ধর্মমতে, জগতের মঙ্গল কামনায় দেবী দূর্গা স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে আসেন এবং ভক্তদের কল্যাণ সাধন করে শত্রুর বিনাশ ও সৃষ্টিকে লালন করেন। অশুভ শক্তির বিনাশ এবং সত্য ও সুন্দরের এই আরাধনা শারদীয় দূর্গোৎসবের তাৎপর্যকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে। সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের অপূর্ব মেলবন্ধনের অনন্য নিদর্শন বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ধারাকে সমুন্নত রেখে এবারের দূর্গাপূজাও সারাদেশে নির্বিঘ্নে এবং যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে। এদিকে, সরকার নির্বাহী আদেশে বুধবার মহানবমীতে ছুটি ঘোষণা করেছে। পরদিন বৃহস্পতিবার শারদীয় দুর্গাপূজার বিজয়া দশমী উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি। এর সঙ্গে শুক্রবার ও শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে টানা চার দিনের ছুটি উপভোগ করবে দেশবাসী।