ডেস্ক রিপোর্টার, ৩০সেপ্টেম্বর।।
              পার্বত্য ত্রিপুরাকে দুই টুকরো করার দাবি আজকের নয়। বহু বছর ধরেই চলে আসছে ত্রিপুরা ভাবের অযৌক্তিক দাবি। কখনো “স্বাধীন ত্রিপুরা”, আবার কখনো “তিপ্রাল্যান্ড”। মূলত রাজনীতির ময়দানে দর হাকানোর জন্যই রাজ্যের জনজাতি অংশের একাংশ “স্বাধীন ত্রিপুরা” বা “তিপ্রাল্যান্ড”র ফেরীওয়ালা হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তারা সফল হননি। রাজ্যের জাতি – জনজাতি উভয় অংশের মানুষ তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছে।এখন এই সমস্ত ধান্ধাবাজ ফেরীওয়ালাদের অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খোঁজে পাওয়া দুষ্কর।
              ২৩- র মহাযুদ্ধকে সামনে রেখে স্বাধীন ত্রিপুরা, তিপ্রাল্যান্ডের নতুন আপডেট ভার্সন এখন
” গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ড”। নতুন ভার্সনের স্বপ্নের ফেরীওয়ালা  প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মন। তার রাজনৈতিক মঞ্চ তিপ্রামথাকে সামনে রেখে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি তিনি সরব হয়েছেন তিনি। ঝড় তুলছেন গোটা রাজ্যে। এবং রাজনীতির ভর কেন্দ্র হয়ে উঠার প্রয়াস শুরু করেছেন। রাজনীতিকদের বক্তব্য, ‘তিপ্রাল্যান্ড’ বা ‘ স্বাধীন ত্রিপুরা’ নাম নিয়ে রাজ্যের রাজনীতির ময়দান উত্তপ্ত করে তুলতে চেয়েছিল জনজাতিদের একটা স্বার্থনেশী মহল।  
উল্কাপাতের মতই দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভেও গিয়েছে তারা। কারণ তাদের এই দাবি ছিল অযৌক্তিক। ইতিহাসের দিকে তাকালে বারবার দেখা যায়, অবস্তবিক, নিষ্প্রয়োজন আন্দোলন কখনোর দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। মাথা তুলে দাঁড়ানোর আগেই স্তব্ধ হয়ে যায়। থুবড়ে পড়ে আন্দোলনের ফলা।এটাই চরম বাস্তব।
        বর্তমানে প্রদ্যুৎ কিশোরের গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবিও অযৌক্তিক। এই দাবিও খুব শীঘ্রই তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়বে।তখন প্রদ্যুতের আন্দোলনের ফলাও ভোতা হয়ে যাবে। বলছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। তাদের বক্তব্য, প্রদ্যুৎ কিশোর একজন উচ্চাকাঙ্খী ব্যক্তি। তবে তিনি  অবিচক্ষণ, ও  অদুরদর্শী। প্রদ্যুৎ ক্ষমতালোলুপ ও আবেগতাড়িত হয়ে নাকি অবাস্তববোচিত ওই চিন্তাধারা নিয়ে অযৌক্তিকতার স্রোতে ভেসে চলেছেন। প্রদ্যুতের এই চিন্তা ভাবনা  ত্রিপুরাবাসীর সামগ্রিক স্বার্থ বিরোধী ও বাঙালী-বিদ্বেষ-প্রসূত।


প্রদ্যুৎ কিশোরের গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি কতটা অযৌক্তিক? এই প্রতিবেদনে   তার স্বপক্ষে  ঐতিহাসিক যুক্তি তুলে ধরেছেন রাজনীতির বিশ্লেষকরা।


**   রাজ্যের জনজাতিরা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত
_____________________________________
  এই ভূ- ভাগের ‘ত্রিপুরা’ নাম খুব বেশী দিনের নয়।আজ থেকে মাত্র ছয়শ বছরের পুরোনো। বার্মা তথা বর্তমান মায়ানমার থেকে আগত ‘ফা’ উপাধিকারী মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত ও তিব্বত-বর্মী ভাষা গোষ্ঠীর লোকেরা এখানে এসে বসবাস করতে শুরু করেছিল।  এই কারণেই নাকি  ভূ- ভাগটির নাম হয়েছে ‘ত্রিপুরা’ (মতান্তর আছে)। ইতিহাসের এই অঙ্কের হিসেব ধরলে রাজ্যের জনজাতিরা বহিরাগত। স্বাভাবিক ভাবেই “ত্রিপুরা” নামটি তিপ্রাদের স্মারক করে ‘তিপ্রাল্যান্ড’ গঠনের দাবিকে নিশ্চিত ভাবে  দুরভিসন্ধিমূলক বলেই ব্যাখ্যা করছেন  ঐতিহাসিকরাও।
  

** ত্রিপুরার পূর্বের নাম শ্রীভূমি
_____________________________
        “ত্রিপুরা” নামকরণের পূর্বে প্রায় ১২০০ বছর এই ভূ-ভাগটি  ‘শ্রীভূমি’ নামে পরিচিত ছিল। শ্রীভূমি ছিল বাংলা  তথা বঙ্গ ডবাক তথা উপবঙ্গের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। পৃথিবীতে মানুষ জাতির সভ্যতার আঁতুড় ঘর ‘রাঢ়’ ভূমি প্রায় ৩০ কোটি বছরের প্রাচীন। এই শ্রীভূমি তথা ত্রিপুরার উৎপত্তি  রাঢ় ভূমির সমসাময়িক।এই বক্তব্য পোষণ করছেন ঐতিহাসিকরা। দার্শনিক ও ইতিহাসবিদ প্রভাত রঞ্জন সরকারের মতে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই ত্রিপুরায় বাঙালিরা বসবাস করে আসছে। ব্যতিক্রম শুধু তিপ্রাসারাই। তারা ব্রহ্মদেশ থেকে খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে  শ্রীভূমিতে এসেছিলো। সুতরাং তারা কোনো ভাবেই ভূমিপুত্র নয়।
 
** জনজাতিরা ত্রিপুরার প্রকৃতি ভূমি পুত্র নয়।
________________________________________
              ত্রিপুরার প্রখ্যাত মুদ্রাগবেষক ও ইতিহাস বিশ্লেষক প্রয়াত জহর আচার্যীর  প্রণীত “ত্রিপুরায় ইতিহাস” বইয়ের ১ম খণ্ডে ৮৮ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে
“চতুর্দশ শতাব্দীর পূর্বে ত্রিপুরায় তিপ্রা রাজাদের কোনরকম প্রমাণ আজও মিলেনি, বরং মিলেছে সমতট (আঠারমুডার দক্ষিণ দিক থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত) ও হরিকেল (আঠারমুড়ার উত্তর দিক থেকে সিলেট পর্যন্ত) রাজ্যের প্রমাণ।” এর থেকে প্রমাণিত যে তিপ্রাসারা সহ অন্যান্য জনজাতিরা বাংলার  অবিচ্ছেদ্য ভূখণ্ড ত্রিপুরায় বহিরাগত। অর্থাৎ যে অর্থে আর্যরা বা নিগ্রোরা ভারতে বহিরাগত তথা আদিবাসী বা ভূমিপুত্র কোনটাই নন, তদ্রূপ ত্রিপুরায় তথা উত্তরপূর্ব ভারতে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত জনজাতিরাও বাংলার মাটিতে কোন আদিবাসী বা ভূমিপুত্র নন। তাই তিপ্রাল্যাণ্ডের দাবী সম্পূর্ণ ভাবে অযৌক্তিক বলেই মনে করছেন ওয়াকিবহাল মহল।


** এডিসিতেই কি বাঙালি বিদ্বেষী বীজ বপন?
________________________________________

রাজনীতিকদের ভাষায়, ভারতে  বাঙালী বিদ্বেষী হীনচক্রান্তকারীদের গভীর ষড়যন্ত্রে ভারতীয় সংবিধান সংশোধন করে এডিসি গঠন করা হয়েছিলো। উদ্দেশ্য ছিল জনজাতি তোষণের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করা। কিন্তু রাজনৈতিক মুখোশধারীদের স্বার্থসিদ্ধি হওয়া ছাড়া সাধারণ জনজাতিদের কোন উপকারে আসেনি এডিসি। আজও সহজ সরল জন জাতিদের ছড়ার জল, বৃষ্টির জল খেয়েই তেষ্টা নিবারণ করতে হয়। তার জন্য অবশ্যই বাঙ্গালীরা দায়ী নয়।দায়ী খোদ রাজ্যের  ধান্ধাবাজ জনজাতি নেতৃত্বরা। রাজ্যের পাহাড়ী অঞ্চলে চোখ মেলে তাকালে প্রকট হয়ে উঠে এই কাতর দৃশ্য। এটা অবশ্যই অস্বীকার করতে পারবেন না  গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের স্বপ্নের ফেরীওয়ালারা। 
   রাজনীতির প্রাজ্ঞদের বক্তব্য,এডিসি আক্ষরিক অর্থে জনজাতিদের উন্নয়নে কাজে আসে নি। তবে সামগ্রিকভাবে ত্রিপুরাবাসীদের মধ্যে স্থায়ী বিদ্বেষ, বিভেদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদকেই ইন্ধন যোগাচ্ছে। এডিসিকে উগ্রপন্থীর অভয়ারণ্য ও বাঙালীর বধ্যভূমি বললে অত্যুক্তি হবে  না বলেই মনে করা হচ্ছে।
       

** ছিট মহলের ন্যায় এডিসি বহির্ভূত অঞ্চল
______________________________________

            ত্রিপুরার প্রামাণ্য দলিল “মানচিত্র”র তথ্য বলছে, রাজ্যের মাত্র  মাত্র ৩১ শতাংশ  উপজাতির জন্যে রাজ্যের ৭০ শতাংশ ভূমি এডিসিভুক্ত করা হয়েছে।অর্থাৎ ত্রিপুরার মোট আয়তন ১০,৪৯২ বর্গ কিমির  মধ্যে ৭,১৩২ বর্গ কিমি। তার মধ্যে  ত্রিপুরার লস্কর কমিউনিটির প্রায় ১,৩৫,০০০, মিজোরাম থেকে আগত প্রায় ৫৬ হাজার রিয়াং ও বাংলাদেশ থেকে আগত প্রায় ৫০,০০০ জন চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।  এই তথ্য বাঙালির সঙ্গে অন্যায় ও অবিচারের জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত বলেই দাবি করছে বাঙালি সমাজ।
      বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবেদনে দেওয়া ম্যাপে আরো স্পষ্ট করে দিয়েছে, এডিসির বহির্ভূত এলাকাগুলো এক একটা ছিটমহলের মতো। বাঙালীদের বসবাসের ক্ষেত্রে এক একটা বদ্ধ এলাকা। যাকে “খোয়ার” বলা যায়। ষষ্ঠ তপশীল রুলস অনুযায়ী, মিজোরামের মতো রাজ্যেও যদি
  ইনার লাইন পারমিট চালু করা হয় তাহলে রাজধানী আগরতলা থেকে উত্তরে ধর্মনগর ও দক্ষিণে সাব্রুম যেতে এডিসি এলাকায়  অন্তত নয়বার প্রবেশ করে  বের হতে হবে।  অর্থাৎ সরকারী পরিভাষায় লাগবে পারমিট।  তখন এই রাজ্যের ছাপোষা (!) বাঙালীদের কি অবস্থা হবে? মানচিত্র অনুযায়ী, রাজ্যের এডিসি অঞ্চল  পরিকল্পিতভাবে বৃহৎ, সুসংবদ্ধ, সন্নিবিষ্ট ও অবিচ্ছিন্ন। অন্য দিকে, এডিসির বাইরের অংশ সংকীর্ণ, খণ্ডিত, অসংলগ্ন ও সংযোগহীন। রাজ্যের এই ভৌগলিক অবস্থায় কোনো ভাবেই গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ড  সম্ভব নয়। এটা অযৌক্তিক।
       

** জনজাতি সম্প্রদায়ে বিভেদ
____________________________

  ত্রিপুরার জনজাতিদের মোট ১৯টি গোষ্ঠী আছে। কথ্যভাষাগত, লোকাচারগত বৈষম্যও রয়েছে।  রিয়াং, লুসাই,  তিপ্রা ও চাকমাদের মধ্যে আছে পারস্পরিক বিভেদ ও অসহিষ্ণুতা। তাই এক তিপ্রাল্যাণ্ডই যে সব জনজাতি গোষ্ঠীর স্থায়ী সহাবস্থানের পথ সুগম করবে তার কোন প্রমাণ ও গ্যারান্টি নেই।


**বাঙালী প্রজাদের অর্থে শক্তিশালী রাজকোষ
_______________________________________
         ত্রিপুরার রাজাদের রাজকোষ স্ফীত হতো বাঙালী প্রজাদের অর্থে। রাজাদের, রাজপরিবারের, রাজ দরবারের, রাজ্যের উন্নয়ণমূলক কাজ, এমনকি সৈন্য সামন্ত পোষণের সমস্ত খরচের উৎস বাঙালী প্রজাদের রাজস্ব। তৎকালীন সমতল ত্রিপুরা তথা মোঘল আমলের চাকলা রোশনাবাদ ও পরে ব্রিটিশ আমলের ত্রিপুরা জেলার (বর্তমান বাংলাদেশভুক্ত) সমস্ত বাঙালী প্রজাদের কাছ থেকেই আসতো রাজস্ব। কারণ পার্বত্য তথা, রাজগী ত্রিপুরার জনজাতি প্রজা সাধারণ ছিলেন নিষ্কর। আজও তারা নিষ্করই।
               তিপ্রামথা এখন  গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের দাবি নিয়ে সরব। কেউ কেউ মথার দাবির সমর্থনে সুর মেলাচ্ছেন। আসলে রাজ্য রাজনীতির অনুপজাতি নেতাদের প্রয়োজন শুধু মাত্র রাজনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য। তাই  প্রদ্যুৎ কিশোরের অনৈতিক দাবি নিয়ে পাল্টা কিছু বলার প্রয়োজন বোধ করছে না। যদি গ্রেটার তিপ্রাল্যাণ্ড ইস্যুতে রাজ্যের আইন – শৃঙ্খলার অবনতি হয়,তাহলে কিন্তু  তার দায় এড়াতে পারবেন না রাজ্যের সব কয়টি রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব। বাস্তব অর্থে রাজ্যের অনুপজাতি রাজনীতিকরা রাজ্যের ইতিহাস কতটা জানেন? নাকি জেনেও ভোটের লাভালাভের জন্য নিজেদের মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছেন? এটা তো বাস্তব, জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হলে এই সমস্ত নেতাদের গোমতী – হাওড়ায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে মানুষ। এটা বিলক্ষণ বুঝতে হবে নেতৃত্বকেও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *