*ঢাকা থেকে হরলাল রায় সাগর*
        ______________________________


             বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় বসে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয়েছিল যুদ্ধকালীন মুজিব নগর সরকার। আর সেখানে বসেই প্রণীত হয় স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র। এই গৌরবোজ্জ্বল দিনটি উপলক্ষে আজ সোমবার ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : ১০ই এপ্রিল ১৯৭১ এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম’ শীর্ষক এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার বেইলি রোডে অবস্থিত ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন, সুগন্ধা) বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) এর আয়োজন করে। সম্মেলনে ‘বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মকথা’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের রচয়িতা, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিলিয়ার চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলাম। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ জমিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী। বিমসটেক’র প্রাক্তন উপদেষ্টা, বিশিষ্ট কবি ও কথা সাহিত্যিক মুজতবা আহমেদ মুরশেদের সঞ্চালনায় সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন  বিলিয়ার অনারারী সেক্রেটারি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। অন্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রোফেশনালস’র (বিইউপি) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়ার অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার ভিনা সিকরি, ফরম ইস্ট পাকিস্তান টু বাংলাদেশ’ শীর্ষক বইয়ের লেখক এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ভিএসএম ব্রিগেডিয়ার আর পি সং, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক অ্যাডভোকেট জেনারেল ব্যারিস্টার বিমল কুমার চ্যাটার্জী, বীর মুক্তিযোদ্ধা এস পি মাহবুব উদ্দীন আহমেদ বীর বিক্রম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। এছাড়া একাত্তরের ঘাদক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ ভারত ও বাংলাদেশের অনেক খ্যাতিমান ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

মূল প্রবন্ধের উপর সুদীর্ঘ আলোচনার এক পর্যায়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম দাবী জানান যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রকে বাংলাদেশের ‘জন্ম সনদ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং ১০ই এপ্রিলকে ‘রিপাবলিক ডে’ ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে। একই সঙ্গে বেশিরভাগ আলোচকই ১০ই এপ্রিলকে ‘রিপাবলিক ডে’ ঘোষণার দাবি জানান।
    ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের ডি-ফ্যাক্টো স্বাধীনতা হয়ে গিয়েছিলো। কেননা, তখন থেকেই সারা দেশ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছিলো। তাঁর মতে, বাংলাদেশের অসহযোগ আন্দোলন গোটা বিশ্বের জন্য একটা দৃষ্টান্ত যে, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে উপেক্ষা বা দমনের চেষ্টা করলে সেটা ভয়াবহ যুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়। ইতিহাস বিকৃতি রোধের প্রতি সবিশেষ গুরুত্ব দেন তিনি।


আইনের ব্যাখ্যা দিয়ে ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অপরিবর্তনশীল। এই ঘোষণাপত্রে বর্ণিত তিনটি মূলনীতি তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার যেন সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে প্রতিপালিত হয়, সেদিকে সজাগ ও সচেষ্ট থাকতে হবে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার যথাযথ বিচার করার জোর দাবি জানান তিনি।
অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, আজকের দিনটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। কেননা বায়ান্ন বছরের পথচলায় এই প্রথমবার এ দিবসটি উপলক্ষে এমন একটি বিস্তৃত আয়োজন করা হয়েছে। তিনি বলেন, পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে একাডেমিক মেধার দারুন সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো বলেই এত সংক্ষিপ্ত সময়ে বিজয় অর্জন সম্ভবপর হয়েছিলো। সেদিক বিবেচনায় তাজউদ্দীন-আমীর জুটির কাছে বাংলাদেশ চিরদিন ঋণি হয়ে থাকবে।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রদূত ভিনা সিকরি বলেন, ভারতবর্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ ভূখন্ডের সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। আর ঐতিহাসিক এই সম্পর্কেরই প্রতিফলন ঘটেছে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের অকুন্ঠ সমর্থনের মধ্য দিয়ে। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ এবং ১০ই এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসে আর্ট অব ইভেন্টস। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিবাচক সম্পর্কের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ভিনা সিকরি।

বিজ্ঞাপন

অবসরপ্রাপ্ত ভিএসএম ব্রিগেডিয়ার আর পি সং বিশেষভাবে স্মরণ করেন ১৯৭১ সালের মুক্তিবাহিনীর কথা। তিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহনী ছিলো এতটাই প্রশিক্ষিত, মানসিক শক্তিসম্পন্ন এবং সুশৃঙ্খল যে, পাকিস্তানী সেনা সদস্যরা সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হতে প্রচন্ড ভয় পেত এবং অস্ত্র সমর্পন করে দিত। তিনি মন্তব্য করেন, ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে রক্ত ঢেলেছে, তাই এই দু’দেশের সম্পর্কও এতটাই সুদৃঢ়।
ব্যারিস্টার বিমল কুমার চ্যাটার্জী বক্তৃতাকালে আবেগাপ্লুত হয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তিনি সে সময় ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরীর জুনিয়র হিসেবে কাজ করতেন। যখন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের খসড়াটি সুব্রত রায় চৌধুরীকে দেখান, তখন ব্যারিস্টার চৌধুরী খসড়াটির প্রশংসায় বলেন যে, এতে বিন্দুমাত্রও পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রয়োজন নেই; যা আমাদেরকে খুবই অবাক করেছিলো।
এস পি মাহবুব উদ্দীন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে মাঠ পর্যায়ে তরান্বিত করতে সাধারণ জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা ছিলো অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়; যা সম্ভবপর হয়েছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলে।


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্য দিয়ে এই ভূখন্ডের মানুষ প্রজা থেকে নাগরিকে পরিণত হয়েছে। এই ঘোষণাপত্র কোনোক্রমেই পরিবর্তন বা সংশোধনযোগ্য নয় বিধায় এটা চিরন্তন। ঘোষণাপত্রটি বাংলায় প্রকাশ ও প্রচার করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি।
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু মন্তব্য করেন, মাত্র ৩৫ বছর বয়সে এমন সুন্দর একটি ঘোষণাপত্র লেখার মতো দুরহ কাজ অত্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। গোটা জাতি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।

বিজ্ঞাপন

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালানোর পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পরে একই বছরের ১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়। একই সঙ্গে কলকাতায় প্রবাসী সরকারের এক অধ্যাদেশে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *