*ঢাকা থেকে সৌরভ হাসান*
——————————————
২০১৬ সালের অক্টোবরে সারাবিশ্বে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে ছিল বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা। ওই বছরের ৩০ অক্টোবর ফেসবুকে ইসলাম ধর্ম অবমাননা করাকে কেন্দ্র করে নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির ও ঘর-বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। ওইসব ঘটনায় দায়ের হওয়া আট মামলার মধ্যে একটির চার্জশিট হয়েছে। বাকি সাত মামলার তদন্ত কাজ এখনও ঝুলে আছে। ফলে দীর্ঘ পাঁচ বছরেও আলোচিত ওই সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।তবে পুলিশ বলছে, সবগুলো মামলার তদন্ত কাজ একেবারে শেষ পর্যায়ে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যেই সবকটির চাজর্শিট আদালতে জমা দেওয়া হবে। প্রথম মামলাটিতে যাদের অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হয়েছিল, তাদের বাকি মামলাগুলোতেও অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে রসরাজ দাসের ফেসবুক আইডি থেকে ২০১৬ সালের ২৭ অক্টোবর পবিত্র কাবা শরীফকে ব্যঙ্গ করে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। ওই পোস্টটি নিয়ে স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে উত্তেজনা দেখা দিলে পরিস্থিতি সামাল দিতে ২৯ অক্টোবর রসরাজকে আটক করে পুলিশ। এরপর নাসিরসগর থানার তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) কাউসার হোসেনের দায়ের করা আইসিটি অ্যাক্টের একটি মামলায় রসরাজকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে মামলাটি জেলা গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।
তবে পুলিশ রসরাজকে গ্রেফতার করলেও উত্তেজনা থামেনি। উল্টো তার ফাঁসির দাবিতে বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো নাসিরনগর উপজেলা। ৩০ অক্টোবর নাসিরনগর উপজেলা সদরের হিন্দু অধ্যুষিত এলাকগুলোতে অতর্কিতভাবে হামলা চালায়। তারা হিন্দুদের অন্তত ১০টি মন্দির ও শতাধিক ঘর-বাড়িতে ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়। পরবর্তীতে ৪ নভেম্বর ও ১৩ নভেম্বর দুই দফায় আবারও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছয়টি ঘর-বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে দুর্বৃত্তরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ায় নাসিরনগর উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়।
সাম্প্রদায়িক ওই হামলার ঘটনায় নাসিরনগর থানায় ক্ষতিগ্রস্তরা বাদী হয়ে সাতটি মামলা দায়ের করেন। মামলাগুলোতে আসামি করা হয় অজ্ঞাত দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে। হামলার ১৩ মাস পর ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর নাসিরনগর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল হাশেম ও হরিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান আতিকুর রহমানসহ ২২৮ জনকে অভিযুক্ত করে গৌর মন্দিরে হামলা মামলার চার্জশিট আদালতে জমা দেয় পুলিশ।
তবে বাকি মামলাগুলোর তদন্ত কাজ এখনও শেষ হয়নি। আদৌ ওই মামলাগুলোর তদন্ত শেষ হবে কি না- সেটি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা। বিশিষ্টজনদের মতে, নাসিরনগরের ঘটনায় দোষীদের বিচার হচ্ছে না বলেই দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে।
নাসিরনগর উপজেলা সদরের দত্তবাড়ি মন্দির ভাঙচুর মামলার বাদী কাজল জ্যোতি দত্ত বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কারণ এ নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথম দিকে পুলিশ যেভাবে তৎপর ছিল এবং মামলার বিষয়ে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত- এখন সেটি হয় না বললেই চলে’।
জেলা নাগরিক ফোরামের সভাপতি পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই বার বার সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটছে। প্রতিটি সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার মানবতাবিরোধী অপরাধের মতো বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি করা উচিত। অন্তত একটি সাম্প্রদায়িক ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হলেও এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না বলে আমাদের বিশ্বাস’।
পুলিশের করা আইসিটি অ্যাক্টের মামলাটিতে রসরাজ দাস বর্তমানে জামিনে আছেন। গত ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতের আদেশে মামলার বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন পাওয়ার আগ পর্যন্ত রসরাজের জামিন মঞ্জুর করা হয়।
রসরাজের আইনজীবী নাসির মিয়া জানান, ‘মামলার বিষয়ে পুলিশ প্রতিবেদন না পাওয়া পর্যন্ত রসরাজকে জামিন দিয়েছিলেন আদালত। কিন্তু পুলিশ এখনও পর্যন্ত আদালতে প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি। এর ফলে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রসরাজের জামিন মঞ্জুর করে আদালতের দেওয়া আদেশ এখনও বলবৎ আছে। পুলিশের প্রতিবেদন পাওয়ার পর মামলার কার্যক্রম আবার শুরু হবে’।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিক্তি পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোল্লা মোহাম্মদ শাহীন বলেন, ‘মামলাগুলোর তদন্ত কাজ শেষ করে আমরা সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই আদালতে চার্জশিট জমা দিতে পারব বলে আশা করছি। প্রথম চার্জশিট হওয়া মামলাটিতে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাদের বাকি মামলাগুলোতেও অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেওয়া হবে’।
তিনি আরও বলেন, ‘রসরাজের মামলাটির তদন্ত কাজও শেষ পর্যায়ে। ফরেনসিক প্রতিবেদনের জন্য আদালতে প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হচ্ছিল। সম্প্রতি আমরা ফরেনসিক প্রতিবেদন পেয়েছি। এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বর্তমানে একটি প্রশিক্ষণে আছেন। তিনি প্রশিক্ষণ শেষ করে এলেই এই মামলাটিও আমরা শেষ করতে পারব।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *