রাজ্যে এই মুহূর্তে চলছে পুর ও নগর ভোটের আবহ।প্রচার পাল্টা প্রচারে সরগরম রাজ্য রাজনীতি।তারপরও বেজে উঠবে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা। কেমন হবে ২৩-র বিধানসভা নির্বাচন? কি হতে পারে নির্বাচনের চরিত্র? শাসক দল বিজেপি,বিরোধী দল সিপিআইএম ও তৃণমূল কংগ্রেস রাজনীতির শতরঞ্জে কোন “কার্ড” খেলবে? ২৩-র মহারণের নির্বাচনী প্রেক্ষাপট নিয়ে “জনতার মশাল”-এ কলম ধরছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক… *মৃণাল সিনহা*।
২৩-র বিধানসভা নির্বাচনে পার্বত্য ত্রিপুরা হতে চলেছে ‘নাশকতা ও বিস্ফোরণের পরীক্ষাগার’। রাজ্যের চলমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকেই এই ভয়ানক পরিস্থিতি আচ করা যাচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রচারণার মেজাজ দেখে মনে হচ্ছে ২৩-র মহারণ হবে সম্পূর্ন ব্যতিক্রমী।
রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে হবে বহুমুখী লড়াই। তবে লড়াইয়ের প্রথম বন্ধনীতে থাকবে শাসক দল বিজেপি,বিরোধী সিপিআইএম,তৃণমূল কংগ্রেস ও তিপ্রামথা।তাতে যোগ হবে নতুন মাত্রা। হবে ভোটের নয়া মেরুকরণ।ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে ‘উন্নয়ন কার্ড’ খেলবে শাসক দল বিজেপি। তবে অবশ্যই ‘ব্রহ্মস্ত্র’ হিসাবে শাসক শিবির ব্যবহার করবে হিন্দুত্বের কার্ডও।তৃণমূলের ট্রাম কার্ড হবে “বাংলা মডেল” ।ত্রিপুরার ভোটারদের কাছে বাংলার উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরবে মমতার সেনারা।এবং শেষ অস্ত্র হিসেবে ভোট ময়দানে ‘বাঙালি ভাবাবেগ’কেও কাজে লাগাতে পারে মমতার দল।বিরোধী দল সিপিআইএম, যথারীতি ভিশন ডকুমেন্টের অ-পূরণের দিকে মনোনিবেশ করবে। বাজবে বিজেপি’র সন্ত্রাসের ক্যাসেট। আওয়াজ তুলবে গণতন্ত্রের অপমৃত্যুর।
পাহাড় রাজনীতির ক্ষমতার অলিন্দে থাকা প্রদ্যুত কিশোরের তিপ্রামথা ভোটারদের সামনে তুলে ধরবে গ্রেটার তিপ্রাল্যান্ডের “লোগো”।
আর অসুস্থ কংগ্রেসকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন দল নায়ক বীরজিত সিংহ।তবে কংগ্রেস ভোটারদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবেনা।অভ্যন্তরীণ কলহ আগামী দিনে দলটিকে সাইনবোর্ড স্বর্বস করে দেবে।
পরবর্তী অঙ্কের হিসাব যায় হোক না কেন, আসন্ন পুর ও নগর ভোট সব কয়টি রাজনৈতিক দলের কাছে অগ্নি পরীক্ষা। এই কারণেই পুর ভোট যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এমন এক সংকটময় সময় অতিক্রম করছে যেখানে সব রাজনৈতিক দলই তাদের উল্টো পরিকল্পনা দিয়ে ভোটারদের বিষিয়ে তুলতে শুরু করেছে।সম্প্রতি সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনা অন্য রাজনৈতিক দলের ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
গত বিধানসভা নির্বাচনের পর প্রধান বিরোধী দল সিপিআইএম’র নেতৃত্ব অন্তত দুই বছরের জন্য চলে যান “হাইবারনেশনে”। নেতৃত্বের হাইবারনেশন সময়কালে, ক্যাডার ভিত্তিক দল সিপিআইএম ক্ষমতাসীন সরকারকে অপদস্থ করার জন্য অনেকগুলি পরিকল্পনা করেছিল। নিজেদের রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্হান পরিবর্তন করেছিল।বাম নেতারা তাদের উত্সাহী সমর্থকদের “ট্রাবল শ্যুটার” হিসাবে বিজেপিতে যেতে বলেছিলেন। পরবর্তীতে তারা বিজেপিতে বিভিন্ন পদ আঁকড়ে ধরে।এবং পুরানো বিজেপি’র কর্মীদের সরিয়ে দিয়ে। বামেরা এই চাল দিয়েছে যথেষ্ট সুনিপুন ভাবে ।
দ্বিতীয় তারা এখন গঠন করেছে পাল্টা প্রতিরোধ বাহিনী। ধীরে ধীরে বামপন্থী নিরীহ সমর্থকরাও এখন রাজপথে নামতে সাহস পাচ্ছে। সর্ব প্রথম এর প্রতিফলন ঘটেছে ধনপুরে গত ৬ সেপ্টেম্বর।বিরোধী দলীয় নেতা মানিক সরকার তার ধানপুর নির্বাচনী এলাকায় একটি জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। পথে তাঁর কনভয়কে কয়েকজন বিজেপি কর্মী বাধা দেয়। এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই সিপিআইএম কর্মী ও সমর্থকরা এগিয়ে আসে এবং পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলে।এক লহমায় ধনপুর হয়ে উঠে ছিলো রণক্ষেত্রে। উভয় পক্ষে আহত হয়েছিলো অনেকেই।রাজ্যে “প্রহরী” পরিবর্তনের পর এটিই প্রথম ঘটনা, যখন বামরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলো। ধনপুরের ঘটনার দুইদিন পর অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিলো রাজধানী। মানিক সরকারের উপস্থিতিতে বিজেপি কর্মীদের উপর হামলাকে কেন্দ্র করে, বিজেপি সমর্থকরা মেলারমাঠ পার্টি অফিসে ভাঙচুর চালায় অভিযোগ বামেদের।একটি প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া হাউসেও রাজনৈতিক দুষ্কৃতীরা হামলা করে।
রাজনৈতিকরা মনে করেন ঘটনাটি বাম নেতা তথা প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ভানুলাল সাহার একটি “আবেদনে”র ফলাফল। ভানুলাল সাহা তাঁর সমর্থকদের সামাজিক মাধ্যমে আবেদন জানিয়েছিলেন, “সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে বিজেপি কর্মীদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য”।রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তার সমর্থকদের আত্মরক্ষার জন্য বেলচা, কুড়াল, দা’য়ের মতো অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বলেছিলেন।”
বাম সমর্থকদের পরিবারের সদস্যদের জীবন বাঁচাতে তাদের পেট্রোল বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র হামলা ব্যর্থ করতে অবিলম্বে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।সর্ব ভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্য সফরেও হিংসার ঘটনা ঘটেছিলো।অভিযোগ তৃণমূল কংগ্রেসের।তারমধ্যে নতুন সংযোজন বিজেপি’র বিধায়ক অরুণ চন্দ্র ভৌমিকের বিস্ফোরক বক্তব্য। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের “তালিবানি কায়দায়” আক্রমনের কথা বলেছিলেন দলীয় কর্মী-সমর্থকদের।
তৃণমূল নেত্রী মমতার জন্য, এটি ত্রিপুরায় তৃতীয় প্রয়াস। প্রথমবার ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুধীর মজুমদারের নেতৃত্বে ত্রিপুরার মাটিতে তৃণমূলকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন।দ্বিতীয় বার বর্তমান বিজেপির বিধায়ক সুদিপ রায় বর্মনের হাত ধরে।কিন্তু মমতা ত্রিপুরাতে ঘাসফুল ফোটাতে ব্যর্থ হন।এবার আপাতত সুস্মিতা দেব,সুবল ভৌমিককে সামনে রেখে ভীত শক্ত করার চেষ্টা করছে তৃণমূল কংগ্রেস।রাজনীতিকরা বলছেন, মমতার এই আস্ফালন মূলত তৃণমূলকে জাতীয় দলের ট্যাগ পাইয়ে দেওয়ার জন্য। এবারও রাজ্যের মানুষ মমতার উপর ধীরে ধীরে আস্থা প্রদর্শন করতে শুরু করেছে।তবে এর স্থায়িত্ব কতটা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
এই মুহূর্তে রাজ্যের লাল পাহাড়ের শক্তিশালী সংগঠন তিপ্রামথার পক্ষে এডিসির আওতাধীন ২০টি আসন বিধানসভা ভোটে ছিনিয়ে নেওয়া কঠিন কাজ।সর্বশেষ এডিসি নির্বাচনে ১৮টি আসন পেয়েছে তিপ্রামথা। বাদবাকি ১০টি আসন পেয়েছে বিজেপি।বামেরা নেমে এসেছে শূন্যের কোঠায়।আর আইপিএফটি উড়ে গেছে খড়- কুটুর মত।
এবারই বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়েও বইবে রক্তের আবহ। আশঙ্কা রাজনীতিকদের। পাহাড়ে তিপ্রাকে জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে গণমুক্তি পরিষদ।জিতেন্দ্র চৌধুরী সিপিআইএম’র রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর গণমুক্তি পরিষদের কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেয়েছে পাহাড়ে। তারা তৈরি হচ্ছে তিপ্রামথাকে জবাব দিতে। পাহাড়ের জমি ছাড়বে না বিজেপিও।সঙ্গে আইপিএফটি। সব মিলিয়ে ২৩-র বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিপুরার রাজনীতির বায়ু বিষিয়ে উঠবে বিষাক্ত গন্ধে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *