ডেস্ক রিপোর্টার,৯জুলাই।। বোধজং নগর থানার জোড়া লাশ কাণ্ডে এখন পর্যন্ত অনুসন্ধানকারী পুলিশ গ্রেফতার করেছে চার অভিযুক্তকে। জোড়া হত্যাকাণ্ডের মাস্টার মাইন্ড বাবুল দেববর্মা এখনো পলাতক। পুলিশ উদ্ধার করেছে খুনের কাজে ব্যবহৃত গাড়িটি।তবে খুনের কাজে ব্যবহৃত অস্ত্রের কোন সন্ধান পায়নি। কেন এই হত্যাকাণ্ড ? অবশ্যই পুলিশ অনুসন্ধান করে কবর খোঁজে বের করেছে সেই কারণ। মূলত ড্রাগস মার্কেটে লেনদেন সংক্রান্ত বিষয় কেন্দ্র করেই পূর্বপরিকল্পিতভাবে জোড়া হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে মাস্টারমাইন্ড তথা নন্দননগরস্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্রের মালিক বাবুল দেববর্মা।

পুষ্পক সাহা ও বাসুদেব দেববর্মার জোড়া লাশ।

* হত্যাকাণ্ডের মোডাস অপারেন্ডি
________________________________

মাদক কারবারের ১২ লক্ষ টাকার লেনদেনের সূত্র ধরেই নন্দননগর স্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্রে খুন হয়েছিল দুই যুবক পুষ্পক সাহা ও বাসুদেব দেববর্মা। তদন্তকারী পুলিশের আতশ কাচের নিচে এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তদন্তের কাটা কম্পাস বারবার নির্দেশ করছে মাদক কারবারের গর্ভগৃহে। অনুসন্ধানকারী পুলিশ অপরাধের কম্পাসের নির্দেশ অনুযায়ী সংগ্রহ করেছে বহু রোমহর্ষকর তথ্য। পুলিশের সংগৃহীত তথ্য থেকে পরিষ্কার রাজ্যে মাদক কারবারের গভীরতার কতটা। তবে এটা নতুন নয়, এর আগেও রাজধানী আগরতলা সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মাদক কারবার কেন্দ্র করে খুন, অপহরণের মতো ঘটনা ঘটেছে। তারপরও পুলিশ মাদক কারবারের লাগাম প্রান্তে পারেনি। বরং উত্তর উত্তর মাদক কারবারের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজ্যের প্রতিটি প্রান্তে। শহর থেকে সমতল গ্রাম থেকে পাহাড় সর্বত্রই মাদক কারবারের চাইদের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়।

* অপরাধ স্থল
____________________
বোধজং নগর থানার অনুসন্ধানকারী পুলিশ জানিয়েছে, গত ৩ জুলাই দুপুরে থানা এলাকার ডিসি পাড়ার বিন্দু মুড়া গ্রামের জঙ্গল থেকে উদ্ধার হয়েছিল পুষ্পক সাহা ও বাসুদেব দেববর্মার রক্তাক্ত লাশ। উভয় লাশ বাঁধা ছিলো দড়ি দিয়ে। লাশ উদ্ধারের পরপরই বোধজং নগর থানার পুলিশ খুনের মামলা রুজু করে তদন্তে নামে। প্রাথমিকভাবে পুলিশের সন্দেহ হয়েছিল মাদককার সংক্রান্ত কোনো বিষয় কেন্দ্র করেই এই জোড়া হত্যাকাণ্ড।


* খুনের ক্লু’র আভাস
______________________

লাশ উদ্ধারের রাতে তদন্তকারী পুলিশ খুন হওয়া দুই যুবকের পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন নিশ্চিত হয় ঘটনার গভীরতা মাদক কারবারের অলিন্দেই। পুলিশ জানতে পারে গত দুই জুলাই রাত দশটা নাগাদ রাজধানীর অ্যাডভাইজার চৌমুহনীর স্থিত বাড়ি থেকে পুষ্পক সাহা ও বাসুদেব দেববর্মা বেরিয়ে আসে এরপর তারা আর বাড়িতে ফিরে যায়নি। পরের দিন দুপুরে উদ্ধার হয় তাদের লাশ।
রাতের আঁধারে কোথায় গিয়েছিল দুই যুবক পুষ্পক ও বাসুদেব? এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে শুরু করে তদন্তকারী পুলিশ। খুন হওয়া দুই যুবকের পরিবারের সদস্যরাই পুলিশের কাছে দাবি করে তারা প্রায়শই নন্দননগর স্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্রে যাতায়াত করত ।এই তথ্যটি সামনে আসার পরেই তদন্তকারী পুলিশ গণনা শুরু করে। তাছাড়া খুন হওয়া পুষ্পক সাহার পুরনো অপরাধ সংক্রান্ত রেকর্ডও নির্দেশ করেছে ড্রাগস কারবারের দিকেই। কেননা গত বছর তিনেক আগে রাজধানীর পশ্চিম আগরতলা থানায় পুষ্পক সাহার বিরুদ্ধে এনডিপিএস একটি মামলা নিয়েছিল পুলিশ। এরপর নেশা কারবারের দিকে পুলিশী তদন্তের ঘ্রাণ আরো গাঢ় হয়ে উঠে।

* পুলিশের সন্ধিগ্ন চোখ
______________________
নন্দনগর স্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্র থেকে ডিসি পাড়ার বিন্দুমুড়ার দূরত্ব খুব বেশি নয়। এই বিষয়টি পুলিশকে ভাবিয়ে তুলে। কারণ বিন্দুমুড়াতেই পাওয়া গিয়েছিল পুষ্পক ও বাসুদেবের রক্তাক্ত লাশ।তাদের মাথায় ছিলো বুলেটের আঘাত।এই নির্জন স্থানে গুলি করলেও শব্দ শোনা যাবে না।তাই পরিকল্পিত ভাবেই পুষ্পক ও বাসুদেবকে নিয়ে আসা হয়েছিলো বিন্দু মুড়াতে। প্রাথমিক ভাবে এমনটাই ধারণা করে তদন্তকারী।তাই তাদের প্রথম টার্গেট পয়েন্ট হয় নন্দননগরস্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্র। অনুসন্ধানকারী পুলিশের আতস কাঁচের নিচে এই বিষয়টি স্পষ্ট তো হওয়ার পর পুলিশ অভিযান চালায় নন্দননগরস্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্র। রাতেই পুলিশ সেখানে পৌঁছায়। নেশা মুক্তি কেন্দ্র থেকে পুলিশ সংগ্রহ করে এই সেন্টারের মালিক ও ম্যানেজারের নাম। পুলিশ জানতে পারে সেন্টারের মালিকের নাম বাবুল দেববর্মা। তার বাড়ি ডিসি পাড়া এলাকায় এবং ম্যানেজারের নাম রহিত সিনহা। তার বাড়ি রাজধানীর বুদ্ধমন্দির এলাকার। রাতেই পুলিশের দুইটি টিম পৃথকভাবে বাবুল দেববর্মা ও রহিত সিনার বাড়িতে অভিযান চালায়। কিন্তু পুলিশ যাওয়ার আগেই বাবুল দেববর্মা গা ঢাকা দেয় নিরাপদ স্থানে। তবে পুলিশ নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ম্যানেজার রহিত সিনহাকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।

ধৃত রহিত সিনহা

* পুলিশের চোখে গোলক ধাঁধা
______________________________

তদন্তকারী পুলিশের টানা জিজ্ঞাসাবাদে রাতেই ভেঙ্গে পড়ে রহিত সিনহা।রহিত পুলিশকে জানায় তার সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিলো পুষ্পক ও বাসুদেবের। উভয়ই প্রায়শই যেতো নন্দননগর নেশা মুক্তি কেন্দ্রে।মাঝেমধ্যেই এই কেন্দ্রে ককটেল পার্টি আসরে বসত তারা। গত ২রা জুলাইও তারা সেখানে পার্টি করে।পার্টি চলাকালীন অবস্থায় পুষ্পক ও বাসুদেবের সঙ্গে তার বাক-বিতণ্ডা হয় ।এর সূত্র ধরেই নেশা মুক্তি কেন্দ্রে উপস্থিত রহিত ও অন্যান্যরা পুষ্পক ও বাসুদেবকে মারধর করে।সেখানেই তাদের মৃত্যু হয়। পরবর্তী সময় লাশ গুম করে প্রমাণ লোপাটের জন্য তাদের নিয়ে আসা হয় ডিসি পাড়ার বিন্দু মুড়া গ্রামে। রহিত সিনহার দেওয়া এই স্বীকারোক্তি পুলিশের বদহজম হয়। অনুসন্ধানকারী পুলিশ বিলক্ষণ বুঝতে পারে রহিত সিনহা ঘটনার মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য পূর্ব পরিকল্পিত একটি স্ক্রিপ্ট উগলে দিয়েছে। কারণ “সিন অফ ক্রাইমে”র সঙ্গে ধৃত রহিতের উগলে দেওয়া খুনের মোডাস অপারেন্ডির হৃদমের সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

* তদন্তের কম্পাসের দিক পরিবর্তন
__________________________________

স্বাভাবিকভাবেই অনুসন্ধানকারী পুলিশকে তার তদন্তের টর্চ লাইট অন্যদিকে ঘোরাতে হয়। এবার পুলিশ তার ফোকাস পয়েন্ট করে নন্দননগর নেশা মুক্তি কেন্দ্রের অন্যান্য কর্মীদের। একদিন পরেই রাতের আঁধারে পুলিশ অভিযান চালিয়ে নেশা মুক্তি কেন্দ্রের তিন কর্মচারীকে গ্রেফতার করে। ধৃতরা হলো প্রসেনজিৎ চৌধুরী, বাপি দেবনাথ ও সোহেল মিয়া। পুলিশী জিজ্ঞাসাবাদে নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ধৃত এই তিন কর্মচারী স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেয় ঘটনার অন্তরালে থাকা হত্যাকাণ্ডের উপপাদ্য বিষয় হলো মাদক কারবারের ১২ লক্ষ টাকার লেনদেন। নন্দননগর নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ভিতরেই চলতো রমরমা নেশা কারবার।

নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ধৃত তিন কর্মী।

* খুন পরিকল্পিত
____________________

ধৃতরা পুলিশকে জানায়, নন্দননগর নেশা মুক্তি কেন্দ্রে মাদকদ্রব্য সাপ্লাই করত খুন হওয়া পুষ্পক ও বাসুদেব। তাদের কাছ থেকে মাদকদ্রব্য ক্রয় করতো নেশা মুক্তি কেন্দ্রের মালিক বাবুল দেববর্মা। বাবুল দেববর্মার কাছে মাদক কারবারের ১২ লক্ষ টাকা জমে যায়। এই পাওনা টাকার জন্য পুষ্পক ও বাসুদেব হামেশাই নেশা মুক্তি কেন্দ্রে যাতায়াত করত। বাবুল তাদের টাকা ফেরত দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। এরপরেই তাদের মধ্যে মতানৈক্য তৈরি হয়। এক সময় একে অপরকে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেয় । পরবর্তী সময়ে অবশ্যই বাণিজ্যের খাতিরে সম্পর্কের বরফ গলে। বাবুল তার পাওনাদার পুষ্পক ও বাসুদেবকে আশ্বস্ত করে, ধীরে ধীরে সব বকেয়ার টাকা মিটিয়ে দেবে। তাতে রাজি হয় পুস্তক ও বাসুদেব।

* অভিশপ্ত রাত ও গুলিতে শেষ নিঃশ্বাস
____________________________________

গত ২রা জুলাই নেশা মুক্তি কেন্দ্রের মালিক বাবুল দেববর্মা পুষ্পক ও বাসুদেবকে তার সংস্থায় পার্টিতে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। সেই অনুযায়ী পুষ্পক ও বাসুদেব রাতে পৌছায় নন্দননগরস্থিত নেশা মুক্তি কেন্দ্রে। আসলে এই আমন্ত্রণ ছিল পূর্ব। পুষ্পক ও বাসুদেবকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে খুন করার জন্যই বাবুল দেববর্মা তাদেরকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। বাবুলের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে পুষ্পক ও বাসুদেব নেশা মুক্তি কেন্দ্রে যায়। প্রথমে তাদেরকে আকন্ঠ মধ্যপান করানো হয়।এরপরই শুরু হয় সঙ্ঘবদ্ধ হামলা। বাবুল দেববর্মা ও রহিত সিনহা পুষ্পক ও বাসুদেবকে বেধড়ক মারধর করে। তাতে অবশ্যই হাত লাগায় নেশা মুক্তি কেন্দ্রের অন্যান্য কর্মীরাও।একসময় আততায়ীদের ক্রমাগত আক্রমনে নেশা মুক্তি কেন্দ্রের মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে পুষ্পক ও বাসুদেব । তখনও তাদের মৃত্যু হয়নি । অর্ধমৃত অবস্থায় উভয়েই ছটফট করছিল রুমের মেঝেতে। হারিয়েছিল কথা বলার শক্তিও। তখনই মক্কা বুঝে বাবুল ও রহিত সহ নেশা মুক্তি কেন্দ্রের অন্যান্য কর্মীরা এই দুজনকে দড়ি দিয়ে বেধে একটি আই- টিয়েন্টি গাড়িতে ঢুকিয়ে দেয়। পরবর্তী সময় এই গাড়িতে করেই পুষ্পক ও বাসুদেবকে অর্ধমৃত অবস্থায় নিয়ে আসা হয় ডিসি পাড়ার বিন্দু মুড়া গ্রামের নির্জন জঙ্গলে। এখানেই তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে খুব সামনে থেকে দাঁড়িয়ে পিস্তল থেকে মাথায় গুলি করে বাবুল। এই নির্জন স্থানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে পুষ্পক ও বাসুদেব। পুলিশের কাছে এই তথ্য তুলে ধরে নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ধৃত তিন কর্মী।

* মাস্টার মাইন্ড বাবুল
________________________

পুষ্পক ও বাসুদেবের মৃত্যু নিশ্চিত করে আই- টুয়েন্টি গাড়ি নিয়ে তারা ঘটনাস্থল থেকে চলে আসে তখনো খুনের কাজে ব্যবহৃত পিস্তলটি ছিল বাবুলের কাছেই। পরে গাড়িটিকে কাশীপুর এক বাড়িতে রেখে তারা প্রত্যেকেই বাড়িতে চলে আসে।এর পর থেকেই নেশা মুক্তি কেন্দ্রের মালিক বাবুল দেববর্মা তার নিরাপদ ডেরায় আশ্রয় নেয় এখন পর্যন্ত বাবুল দেববর্মা পুলিশের রাডারের বাইরে।কবে গ্রেপ্তার হবে জোড়া খুনের মাস্টার মাইন্ড বাবুল? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত নেই অনুসন্ধানকারী পুলিশের কাছে।

উদ্ধার পুষ্পক সাহার ব্যবহৃত মোবাইল ও ব্যাগ।

* উদ্ধার পুষ্পক সাহার মোবাইল ও ব্যাগ
_______________________________________
নেশা মুক্তি কেন্দ্রের ধৃত ম্যানেজার রহিত সিনহার বক্তব্য অনুযায়ী, তদন্তকারী পুলিশ শনিবার শহরের শালবাগান থেকে উদ্ধার করে পুষ্পক সাহার মোবাইল সেট ও ব্যাগ। এদিন রহিত সিনহাকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েই পুলিশ শালবাগানের জঙ্গল থেকে ব্যাগ ও মোবাইল সেট উদ্ধার করে। তদন্ত স্বার্থে রহিত সিনহাকে ফের আদালতে সোপর্দ করেছিল পুলিশ। আদালত রহিত সিনহাকে আগামী ১১ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ রিমান্ডে থাকার নির্দেশ দিয়েছে। পুলিশে জিজ্ঞাসাবাদে ধৃত রহিত জানিয়েছিল, ডিসি পাড়ার বিন্দু মুড়াতে পুষ্পক ও বাসুদেবের লাশ গুম করার পর পুষ্পকের ব্যাগ ও মোবাইলটি নিয়ে তারা চলে এসেছিল গাড়ি করে। শালবাগান অতিক্রমের সময় জঙ্গলে ফেলে দিয়েছিল ব্যাগ ও মোবাইল সেট।


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *