
ডেস্ক রিপোর্টার,আগরতলা।।
উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ থেকে নীরমহল, এম বি বি কলেজ থেকে উমাকান্ত স্কুল। মালঞ্চ নিবাস থেকে ভি এম হাসপাতাল( হালের আইজিএম হাসপাতাল) সহ আরো কত নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাজ্যে। অধিকাংশই তৈরি হয়েছিল রাজন্য শাসিত ত্রিপুরায়।
পাহাড়ি রাজ্য ত্রিপুরায় এত সুন্দর নিদর্শন তৈরি করার জন্য রাজকোষের অর্থের উৎস কোথায় ছিল? কাদের দেওয়া করের টাকায় ত্রিপুরার রাজারা তাদের শাসন কার্য্য পরিচালনা করতেন। এবং বিলাস বহুল জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত ছিলেন? রাজা – মহারাজারা প্রজাদের করের টাকায় রাজ্য চালাবেন। স্ফীত করবেন রাজ কোষ।এটাই তো স্বাভাবিক।

ইতিহাসের তথ্য অনুযায়ী, ত্রিপুরার রাজাদের শাসনকাল শুরু হয়েছিল চতুর্দশ শতকের গোড়া থেকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৪৯ সালে ত্রিপুরা যুক্ত হয়েছিল ভারতের সঙ্গে। ইতিহাস বলছে, রাজতন্ত্রের শুরু থেকেই রাজ্যে বসবাসকারী তিপ্রাসারা ছিল টেক্সের আওতার বাইরে। অর্থাৎ তিপ্রাসা লোকজনকে রাজ কোষে কর দিতে হতো না। রাজতন্ত্রের অবসানের পর এখন উড়ছে গণতন্ত্রের ধবজা। দেশের সংবিধান অনুযায়ী, আজও এই রাজ্যের জনজাতিদের কোনরকম ট্যাক্স দিতে হয়নি। তারা বরাবরের মতোই করের আওতার বাইরে।

রাজতন্ত্রের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই রাজ্যের রাজা-মহারাজারা নানান ক্ষেত্রে উন্নয়নমূলক কাজকর্ম করেছেন। চালিয়েছেন রাজপাট।তার জন্য তো অবশ্যই অর্থের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানের মত আগেও জনজাতি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিল করের আওতার বাইরে। তাহলে কাদের করের টাকায় রাজপাট চালিয়েছেন প্রদ্যুৎ কিশোরের পূর্বপুরুষরা? আজ উঠছে এই প্রশ্ন।

ঐতিহাসিকরা বলছেন,ত্রিপুরা ছিল বঙ্গদেশীয় একটি হিন্দু রাজ্য। সমতটে ছিল হিন্দু বাঙালিরা। বর্তমান ত্রিপুরার অংশে ছিল হিন্দু জনজাতিরা। যদিও কালের বিবর্তনে রাজ্যের জনজাতিরা আজ কেউ খ্রিস্টান বা কেউ বুদ্ধ ধর্ম গ্রহন করেছে। ঐতিহাসিকদের কথায়, বঙ্গদেশীয় স্বাধীন হিন্দু রাজ্য ত্রিপুরার আয়ের মূল উৎস ছিল সমতটে থাকা বাঙালি প্রজাদের করের টাকা।

রাজ্যে বসবাসকারী বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষের বক্তব্য, আজকের দিনে তিপ্রামথার চেয়ারম্যান প্রদ্যুৎ কিশোর দেববর্মনের সমস্ত সম্পত্তির পেছনে বকলমে রয়েছে বাঙালিদের দেওয়া কষ্টার্জিত করের টাকা। জন্মসূত্রে প্রদ্যুৎ কিশোর যে রাজমহলে বেড়ে উঠেছিলেন। এবং যে প্রাসাদে বসে, আজ তিনি রাজনৈতিক কার্য পরিচালনা করছেন, তার দেওয়ালের প্রতিটি রন্ধে রন্ধে রয়েছে বাঙালিদের অর্থ। নীরমহল সহ রাজ পরিবারের বিভিন্ন সম্পত্তি নিয়ে আজও প্রদ্যুৎ কিশোরের মামলা চলছে রাজ্য সরকারের সঙ্গে। রাজাদের তৈরি করা এই সমস্ত সম্পদের পেছনেও ছিল বাঙালি প্রজাদের অর্থই। তারপরও প্রদ্যুৎ কিশোর সহ জনজাতি সম্প্রদায়ের সিংহ ভাগ মানুষ বাঙালীদের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়।বরং তারা বরাবর অকৃতজ্ঞের মত বাঙালিদের নিয়ে নানান কুকথা প্রচার করছে। তারা বাঙালীকে দিচ্ছে তকমা বিদেশির। রাজপ্রাসাদের বাসিন্দা প্রদ্যুৎ কিশোর হোক বা ধলাইয়ে অজ গ্রাম থালছড়ার বাসিন্দা বুধু দেববর্মা হোক। কিংবা বাংলাদেশে বসে থাকা নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন এনএলএফটির সুপ্রিমো বিশ্ব মোহন হোক। প্রত্যেকের কন্ঠেই প্রতিনিয়ত ভেসে উঠছে ত্রিপুরা থেকে বাঙালি বিতাড়নের নগ্ন উপাখ্যান।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠছে, বাঙালিরা যদি বিদেশি হয়েই থাকে, তাহলে ত্রিপুরার রাজাদের কর দেবে কেন? নিয়ম অনুযায়ী, স্বদেশী লোকজনই তো রাজা – মহারাজাদের কর দিয়ে থাকে। ঐতিহাসিকরা আবারও দাবি করছেন , রাজন্য ত্রিপুরার করের প্রসঙ্গ থেকেই প্রমাণিত হয় বাঙালিরা বিদেশি নয়, তারা পুরদুস্ত স্বদেশী। অর্থাৎ বঙ্গদেশীয় হিন্দু রাজ্য ত্রিপুরার বাসিন্দা।

ত্রিপুরার রাজাদের মধ্যে রাধা কিশোর মানিক্য যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ । কদর করতেন বাঙালি ও বাংলা ভাষাকে। ঐতিহাসিকরা তথ্য প্রমাণ দিয়ে বলছেন, মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্য তার মন্ত্রীকে দেওয়া এক চিঠিতে লিখেছিলেন

“এখানে আবহমান কাল রাজকার্যে বাংলা ভাষার ব্যবহার এবং এই ভাষার উন্নতিকল্পে নানারূপ অনুষ্ঠান চলিয়া আসিতেছে, ইহা বঙ্গদেশীয় হিন্দুরাজ্যের পক্ষে বিশেষ গৌরবজনক মনে করি ৷ বিশেষতঃ আমি বঙ্গভাষাকে প্রাণের তুল্য ভাল-বাসি এবং রাজকায্যে ব্যবহৃত ভাষা যাহাতে দিন দিন উন্নত হয় তৎপক্ষে চেষ্টিত হওয়া একান্ত কর্তব্য মনে করি। ইংরেজী শিক্ষিত কর্মচারীবর্গের দ্বারা রাজ্যের এই চিরপোষিত উদ্দেশ্য ও নিয়ম যেন ব্যর্থ না হয়, সে বিষয়ে আপনি তীব্র দৃষ্টি রাখিবেন।”

মহারাজা রাধা কিশোর মানিক্যের এই চিঠি থেকেই স্পষ্ট, ত্রিপুরা ছিল বঙ্গদেশীয় একটি হিন্দু রাজ্য। এই রাজ্যে প্রধান ভাষা ছিল বাংলা ভাষা।।সরকারি কার্য কার্যে ছিলো বাংলা ভাষার ব্যবহার। বরং ইরেজি ভাষার জন্য বাংলা ভাষার প্রচার ও প্রসারে যেনো কোনো প্রভাব না পড়ে, তার দিকে লক্ষ্য রাখতে মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন রাধা কিশোর মানিক্য। আর এখন রাজনীতির ফায়দা তুলতে বাঙালীদের বিদেশি সার্টিফিকেট দিচ্ছেন রাধা কিশোরের উত্তরসুরী প্রদ্যুৎ বিক্রম কিশোর মানিক্য। হায় রে! নিজ ভূমে এটাই দেখার বাকি ছিল নেতাজি – সূর্য্য সেন – ক্ষুদিরাম বসুর উওরসুরীদের।