*অভিজিৎ ঘোষ *
                   _______________
       


১৯৪৫ থেকে ১৯৯৪। দীর্ঘ ৪৯ বছর ধরে ত্রিপুরা থেকে বাঙালিদের উৎখাতের জন্য একের পর এক বৈরী দলের জন্ম দিয়েছিলো বিচ্ছিন্নতাবাদী জনজাতি নেতারা। দশকের পর দশক ধরে বাঙালিদের বিরুদ্ধে তারা ষড়যন্ত্র চালিয়ে গেছে। খেলেছে রক্তের হোলি।আজও চলছে অবিরাম। রাজন্য শাসনের শেষ সময় থেকেই বাঙালিদের শিকড় উপড়ে ফেলে দেওয়ার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছিলো রক্ত পিপাসু জনজাতি নেতারা। জনজাতি সম্প্রদায়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের এই ষড়যন্ত্রের কথা লিপি বদ্ধ আছে ইতিহাসের পাতায়। শুধু তাই নয়,টিএনভির প্রাক্তন জঙ্গি নেতা তথা বর্তমান তিপ্রামথা দলের সভাপতি বিজয় রাঙ্খল তার জেনেভার ভাষণে লিখিত আকারে এই সমস্ত তথ্য তুলে ধরেছিলেন।


রাজন্য শাসিত ত্রিপুরাতেই প্রথম বাঙালি উচ্ছেদের জন্য জন্ম নিয়েছিল  জনজাতিদের বৈরী দল।

নাম: সংকরক ।

সময়: ১৯৪৫ সাল ।

জন্ম দাতা: রাজ পরিবারের সদস্যরা।

রাজ আমলেই এই রাজ্যে বাঙালিদের রক্ত বীজ নিশ্চিহ্ন করে দিতে জন্ম নিয়েছিলো সংকরক নামক বৈরী দল। এই দলের সৃষ্টি কর্তা ছিলেন খোদ রাজ পরিবারের সদস্যরা। বাঙালি বিতাড়নের নামে রাজ পরিবারের সদস্যরা জনজাতিদের এক সূত্রে বাধার কাজ শুরু করেছিলো।নানান জায়গাতে সংকরক বৈরী গোষ্ঠীর সদস্যরা সন্ত্রাস শুরু করেছিলো। পুড়িয়ে দিয়েছিল বাঙালিদের বাড়িঘর।মারধর করেছিলো সাধারণ নিরীহ বাঙালিদের। গ্রাস করেছিলো আতঙ্ক। অর্থাৎ ত্রিপুরা ভারত ভুক্তির আগে থেকেই বাঙালিদের শেষ করে দেওয়ার জন্য ব্লু প্রিন্ট তৈরি করেছিলো জনজাতিরা।


নাম: গণমুক্তি পরিষদ।

সময়:১৯৪৮ সাল।

জন্মদাতা: প্রাক্তন কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেব।

রাজ্য থেকে বাঙালিদের বিতাড়নের জন্য ১৯৪৮ সালে দশরথ দেব গণমুক্তি পরিষদের জন্ম দিয়েছিলেন। জিএমপির সদস্যরা রাজ্যে বহু বাঙালির রক্ত ঝরিয়েছিলো। তার মূল মাষ্টার মাইন্ড ছিলেন দশরথ দেব।তিনিও ছিলেন জঙ্গি নেতা। বাঙালির রক্ত খেকো জিএমপি ১৯৫০- এ যোগ দেয় কমিউনিস্টদের সঙ্গে। বাঙালির রক্ত খেকো দশরথ দেবকে কমিউনিস্টরা জঙ্গি নেতা থেকে জননেতা বানিয়ে দেয়।


নাম: সেনকরক।

সময়:১৯৬৮ সাল।

জন্মদাতা: অনন্ত রিয়াং ।

দিন যত গড়াচ্ছিল বাঙালি বিতাড়নের স্টিমরোল ততোই তেজী হচ্ছিলো। ষড়যন্ত্রের ঘড়ি চলছিল প্রতিনিয়ত।১৯৬৮ সালে ফের বাঙালি নিধন কারী বৈরী দল সেনকরক অনন্ত রিয়াংয়ের হাত ধরে হায়ানার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালিদের উপর। শেষ পর্যন্ত অনন্ত রিয়াং তার দলবল নিয়ে পুলিশের কাছে আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হন।


নাম: ত্রিপুরা ন্যাশনাল ভলেন্টিয়ার্স বা টিএনভি।

সময়:১৯৭৮ সাল।

জন্মদাতা: বিজয় রাঙ্খল ।

লাল বৃত্তের মধ্যে থাকা ব্যক্তিটি বিজয় রাঙ্খল।

বিজয় রাঙ্খলের হাত ধরে রাজ্যের পাহাড়ে এক শক্তিশালী বৈরী দলের জন্ম নেয়। টিএনভি ত্রাস সৃষ্টি করেছিলো বাঙালি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা, বাঙালি গ্রামে অগ্নিসংযোগ,অপহরন,বাঙালি নারীদের ধর্ষণ।শিশুদের উপর অকথ্য নির্যাতন।সবই চালিয়ে ছিলো বিজয় রাংখলের নেতৃত্বাধীন টিএনভির সশস্ত্র বাহিনী। পরে দেশের প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর হাত ধরে বিজয় রাঙ্খল তার অনুগামীদের নিয়ে ফিরে আসেন স্বাভাবিক জীবনে।বর্তমানে তিনি প্রদ্যুৎ কিশোরের তিপ্রামথার সভাপতি।


নাম: অল ত্রিপুরা পিপলস অর্গানাইজেশন বা এটিপিএলও।

সময়: ১৯৮০সাল।

জন্ম দাতা: বিনন্দ জমাতিয়া ।


বিজয়  রাংখলের সঙ্গে টিএনভিতেই ছিলেন  বিনন্দ জমাতিয়া।তিনি পরে টি এন ভি থেকে বেরিয়ে গিয়ে গঠন করেন অপর বৈরী দল অল ত্রিপুরা পিপলস অর্গানাইজেশন বা এটিপিএলও। ১৯৮০ সালের দাঙ্গার পেছনে বিনন্দ জমাতিয়ার বৈরী দল এটিপিএলও – র অনেক বড় ভূমিকা রয়েছে। ৮০- র দাঙ্গায় হাজার হাজার বাঙালিদের হত্যা করেছে জনজাতি অংশের মানুষ। রাজ্য জুড়েই ছিলো বাঙালির মৃত্যুর মিছিল। তবে দাঙ্গায় বাঙালির পাল্টা প্রতিরোধে জনজাতি অংশের মানুষেরও মৃত্যু হয়েছিল। সংখ্যায় অনেক কম।


নাম: ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা বা এনএলএফটি।

সময়: ১৯৮৯ সাল

জন্মদাতা: ধনঞ্জয় রিয়াং


ধনঞ্জয় রিয়াংয়ের হাত ধরে ফের বাঙালি খেদানোর নাম করে জন্ম নেয় ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা বা এনএলএফটি। বাঙালিদের খুন,অপহরন, বাড়ী ঘরে অগ্নি সংযোগ, বাঙালি নারীদের ধর্ষণ সবেতেই এনএলএফটি ছিলো মাহির।

এনএলএফটি সুপ্রিমো বিশ্বমোহন দেববর্মা।

পরবর্তী সময়ে এন এল এফ টির লাগাম ধনঞ্জয় রিয়াংয়ের হাত থেকে খসে যায়। এনএলএফটি কয়েকটি উপ দলে বিভক্ত হয়ে যায়। নয়নবাসী, মন্টু কলই, বিশ্বমোহনরা ভাগ হয়ে যায়। অন্যান্য দল গুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও এখনো সক্রিয় এনএলএফটি বিশ্ব মোহন গোষ্ঠী। বাংলাদেশে রয়েছে ঘাঁটি। এখনো মাঝে মধ্যে বিশ্বমোহন তার বিষ দাত বসানোর চেষ্টা করেন।

লাশের ত্রিপুরা।

নাম: অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স বা এটিটিএফ।

সময়: ১৯৯০ সাল।

জন্মদাতা: রঞ্জিত দেববর্মা  (বর্তমানে বিধায়ক)

রঞ্জিত দেববর্মা।

এনএলএফটি ও এটিটিএফ্  রাজ্যের এই দুইটি জঙ্গি সংগঠন সমসাময়িক সময়ের। এটিটিএফ গোটা রাজ্য জুড়ে বাঙালি নিধনের ঠিকা নিয়েছিলো।বাঙালিদের রক্ত দিয়ে দলের নেতা রঞ্জিত দেববর্মা স্নান না করতে পারলে তার যেন ভাতেই হজম হতো না। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে সীমান্তের এপারে পাঠিয়ে দিয়েছিল।


রাজ্য পুলিশও তাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছিল। আইনের ম্যারপ্যাঁচ গলে বেড়িয়ে আসেন জেল থেকে। ২৩ র বিধানসভা নির্বাচনে প্রদ্যুৎ কিশোরের তিপ্রামথার টিকিটে রামচন্দ্রঘাট থেকে জয়ী হয়ে বিধায়ক হয়েছেন।

বাংলাদেশের ঘাঁটিতে অবস্থানরত এটিটিএফ জঙ্গি।

নাম: ত্রিপুরা রেসুরেকশন আর্মি( টিআরএ)
 
সময়: ১৯৯৪ সাল।

জন্মদাতা: ধনঞ্জয় রিয়াং।

        ৯০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল ধনঞ্জয় রিয়াং।কিন্তু তিনি টি আর আই করে সুবিধা করতে পারেন নি। তবে বাঙালিদের উপর বেশ কয়েকটি ঘটনা সংঘটিত করেছিলো টি আর এ। মূলত এনএলএফটির বিশ্বমোহন গোষ্ঠী ও এটিটিএফের এক চেটিয়া দাপটের কাছে টিকতে পারে নি ধনঞ্জয় রিয়াংয়ের টিআরএ। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এনএলএফটি ও এটিটিএফের সঙ্গে যুক্ত ছিল ছোট ছোট জঙ্গি সংগঠন।তাদের মধ্যে রয়েছে বিএনসিটি, টিএনএলএফ, টিটিভিএফ, এটিভিটি ইত্যাদি।
      

বিজয় রাঙ্খলের জেনেভা ভাষণের অংশ

প্রাক্তন বৈরী নেতা তথা হালে তিপ্রামথার  সভাপতি বিজয় রাঙ্খল তার জেনেভা ভাষণে স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছিলেন ১৯৪৫ থেকে ১৯৯৪ পর্যন্ত কিভাবে জনজাতিরা বিভিন্ন সময়ে বাঙালি নিধনের জন্য বৈরী দলের জন্ম দিয়েছিল।যদিও তাদের ভাষায় জঙ্গীপনার পোশাকি নাম  সশস্ত্র সংগ্রাম। বর্তমানে প্রদ্যুৎ কিশোরের তিপ্রামথা বকলমে বাঙালি  বিতাড়নের ডাক দিয়েছেন। আর প্রদ্যুৎ নিজেই বলছেন,”এই রাজ্যের হিন্দু – মুসলিম বাঙালিরা বাংলাদেশী।রাজ্যের মন্ত্রী – আমলারাও বাংলাদেশী।”

রাজ্যে বাঙালি নিধনের কদর্য রূপ।

ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যে আবেশের মধ্যে ছিলেন, প্রদ্যুৎ কিশোরও তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন নি। পারবেন ই বা কি করে? কারণ রাজন্য শাসিত ত্রিপুরাতেই রাজ পরিবারের সদস্যরা বাঙালিদের নিধনের জন্য তৈরি করেছিল রাজ্যের প্রথম বৈরী সংগঠন “সংকরক”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *