আজ স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষে গান্ধী জয়ন্তী প্রাক্কালে ব্যক্তির পরিসরে যখন তাঁকে স্মরণ করছি আজ গান্ধীবাদের নামে গান্ধীগিরি অনেকটাই স্তিমিত হলেও গান্ধীকে গডসের সঙ্গে একাসনে বসিয়ে পূজা করার চেষ্টা চলছে। এই ঘটনাগুলি গান্ধীর দর্শন আর আদর্শকে কি আমাদের থেকে আরও আরও  অনেক দূরে সরানো হচ্ছে নাকি গান্ধীকে আমাদের ব্যক্তি, সমাজ রাষ্ট্রজীবনে আরো প্রাসঙ্গিক করে তুলছে ?—– লিখেছেন তাপস দে।


দেশের , চারপাশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে কিছু ভাবতে গেলে বলতে গেলে আমরা বাপুজির কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আর কোনও পথ খুঁজে পাই না। গান্ধীজির জীবনাদর্শ , তার জীবনদর্শনই আজকের দিনেও আমাদের পাথেয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে , তার মৃত্যুর পর রাষ্ট্রের মুদ্রা থেকে শুরু করে পথ-সরনি , উদ্যান-প্রতিষ্ঠানে তিনি ছেয়ে গেলেও তার আদর্শ আর পথ নিয়ে এক অদ্ভুত শীতলতা তৈরি হতে থাকে। যা দিনে দিনে গান্ধীবাদকে গান্ধীগিরিতে পরিনত করে ।সেই গান্ধীবাদের অন্তরালে তৈরি হতে পারে আর এক অভিমুখ। আমাদের সমাজে সম্পদের বৈষম্য আর ভোগবাদী আগ্রাসন একদিকে যেমন নৈতিকতার সঙ্কট ডেকে আনে তেমনি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে আসে অন্য ব্যবধান। দৃশ্যত গান্ধীজির জীবদ্দশায় তিনি যে মত আর পথকে রাষ্ট্রহিতে দূরে রাখতেন এবং আমৃত্যু রেখে গেছে সেই মত আর পথ আপাত দৃষ্টিতে জোরশোর আমাদের চক্ষুকর্নকে বিদীর্ন করতে চাইছে।


আমি বিশ্বাস করি গান্ধী আজ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছেন আরও এক বার এ সব কারনেই। কিন্তু তাঁকে ধরা খুবই কঠিন বা সহজ। এই বছর দূর্গোসবের মধ্যে পড়ে গেছে দোসরা অক্টোবর। ভালোই হল। আনুষ্ঠানিকতার ক্যাচাল পেরিয়ে গান্ধীজি থাকুন আমাদের আন্তরিক ভাবনায়। গান্ধী সম্পর্কে রাষ্ট্রগত শীতলতার মধ্যেও গান্ধীর ইউএসপি(ইউনিক সেলিং প্রাইস) নিয়ে ভাবনায় মত্ত থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই আমলে স্বচ্ছ ভারত অভিযানে আমরা দেখেছি গান্ধীর চশমার ইউএসপি কত ওপরে। লক্ষ মিলিয়নের স্বচ্ছ ভারত অভিযানে গান্ধীর চশমায় এক চোখে লেখা হল স্বচ্ছ ওপর চোখে লেখা আছে ভারত। সেই অভিযানের ফলাফল আমরা সবাই দেখেছি। যে চোখ স্বচ্ছ তাতে ভারত নেই । আর যে  চোখে ভারত দেখা যায় তা আর স্বচ্ছ নয়।


রাষ্ট্রের ভাবনা দিয়ে গান্ধীকে ভাবা যায় না। তাঁকে ভাবতে  হয় ইশ্বর ভাবনার মতো নিভৃতে, ব্যাক্তির ব্যক্তিগত পরিসরে। এভাবে আজকের দিনে নতুন করে গান্ধী ভাবনার সূচনা করা দরকার।এর পর আসুক সমষ্টি। বর্তমানের যে প্রেক্ষিতে বসে গান্ধীভাবনা তাতে বলা যায় , উদারপন্থী ও মানবতাবাদীদের নতুন করে গান্ধীভাবনাকে মানুষের সামনে আনতে হবে। আনুষ্ঠানিক ভাবে নয় আন্তরিকভাবে গান্ধীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়কে উপলব্ধি করা দরকার এর আগে। এই কাজটি করার জন্য প্রথমেই রাজনীতি পরিহার করা দরকার। তা হলে হয়তো কাজটি সহজ হবে। কোনও তুলনা প্রতিতুলনার চেয়েও বেশি দরকার সুখের সংজ্ঞা নির্ধারন। সুখ সম্পর্কে আজকের সমাজ আগের চেয়ে অধিক সংবেদনশীল এবং সুখ বা সুখানুভূতি নিয়ে গান্ধীজির চেয়ে আর কেউ ভালো সংজ্ঞা দিতে পারেন না বলে আমি বিশ্বাস করি। এই জায়গাটির মীমাংসা হয়ে গেলে সমাজের অর্ধেকের বেশি সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।


গান্ধীজি আশ্রম গড়েছিলেন শান্তিনিকেতনের আদর্শে। প্রথমে ১৯১৫ সালে আমেদাবাদের কোচবর বলে এক জায়গায় আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন । পরে ১৯১৭ সালে সবরমতিতে আশ্রম স্থানান্তর করেন। সেই আশ্রমের স্বপ্ন আর ভাবধারাগুলি যা ছিল তা আমাদের পুনঃপাঠ দরকার।সবার জানা দরকার।
১) সত্যের ব্রতঃ সব কিছুর চেয়ে সত্য বড়। ২) অহিংসার ব্রতঃ অত্যাচারের প্রতিবাদ হবে তবে আক্রমণ করে নয়। ৩) কৌমার্যের ব্রতঃ নারী সমাজকে কামনার দৃষ্টিতে না দেখা। ৪) রসনার সংযম ৫) চুরি না করার অঙ্গীকার ৬) অধিকার ত্যাগঃ অতিরিক্ত সম্পদ না রেখে জীবনে সরল পথ গ্রহন ৭)স্বদেশি ব্রতঃ দেশকে ভালোবাসা, স্বদেশি পন্য গ্রহন। ৮) নির্ভিকতার সংকল্পঃ মৃত্যু ভয় দূর করে সাহস সঞ্চয়ের মাধ্যমে নিজের শক্তিতে সকল বাধা দূর করা। ৯) পরিশ্রমের ব্রতঃ নিজের কাজ নিজে করা। এই কয়েকটি বিষয় ব্যক্তির জীবনে যখন চলে আসে সেই জাতি হবে মহাশক্তিমান এবং সেই সমাজ হবে সুখের, সাম্যের।


কিন্তু এই যে সময় বা পরিপ্রেক্ষিত এখানে আমাদের সমাজ বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজ আত্মসুখে এতোটাই নিমজ্জিত যে প্রকৃত হৃদয় দিয়ে কিছু উপলব্ধির দিন বুঝি আজ শেষ । আমাদের জীবনে গান্ধী জয়ন্তী হোক, প্রজাতন্ত্র কিংবা স্বাধীনতা দিবস, নেতাজি সুভাষ, ক্ষুদিরাম , বাঘা যতীন তাঁদের বীরগাথাকে স্মরণ কৃত্রিমতায়  ছেয়ে গেছে।তাঁদের জীবন আত্মত্যাগের গাঁথা মুখস্ত করা হলেও সেই জীবন বা আত্মত্যাগ থেকে শিক্ষাটাই নেওয়া হয় নি। সেই সব জন্মজয়ন্তী মানে একটি ছুটির দিন। দুপুরে্র পাতে  মাংস ভাত , একটু লম্বা ঘুম, একটা লম্বা আড্ডা ব্যস। কখনো কখনো ফাঁকা বক্তৃতা যে হয় না তা নয়। টিভিতেও এই সব বক্তৃতা আসে হাজারো লোভনীয় পণ্যের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে। সেইসব বক্তৃতা যতটা না মানুষের মনে দাগ কাটে তার চেয়ে অধিক দাগ কাটে বিজ্ঞাপন। নব্যযুবা থেকে বিগত যৌবনা সবারই হাত দীর্ঘ হয় এই সব বিজ্ঞাপনে। যদিও বিশ্বের ক্ষুধা সূচকে এই দেশের অবস্থান ক্রমশ নিম্নগামী তথাপি এই দেশে লোভনীয় সেই সব পন্যের ক্রয়ক্ষম মানুষের সংখ্যা ইউরোপের অনেক দেশের সমান বা কখনো কখনো বেশি। ফলে ভারতের বাজার নিয়ে বহুজাতিক কোম্পানিগুলির আগ্রহ বেশি।


মধ্যবিত্তের স্বামী স্ত্রী যখন চাকরি করেন তাঁদের ঘরে প্রয়োজনের তুলনায় যখন অনেক বেশি সঞ্চয় বা রোজগার হয় তখন তাঁদের ঘরে গান্ধী, নেতাজি সুভাষ ক্ষুদিরামের চেয়ে কেন থাকবেন ? তুলনায় বিজ্ঞাপনের মোহিনীরা, সিনেমা টিভি সিরিয়ালের নায়িকারা আর সেই সবে প্রদর্শিত কোটিপতির জীবনচর্চাই বেশি বেশি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠে। এই জীবনে রাত্রির সীমানা জুড়ে যে মৌজ মস্তির জীবন তা খালপাড়ের বস্তির আধপেটা জীবনের সঙ্গে এক অশ্লীল বৈপরীত্য তৈরি করে। এই উশৃঙ্খলতাকে ব্যক্তি স্বাধীনতাকামীরা ব্যক্তির স্বাধীনতা বলে দাবি করেন । তাঁরা কিন্তু  কখনোই আত্ম সংযমের কথা বলেন না। গান্ধীজি দেখিয়েছেন,আত্ম সংযম কখনোই  জন্মসূত্রে প্রাপ্ত হয় না। এটি অর্জন করতে হয়। রক্তমাংসের শরীরে আজীবন পরীক্ষানিরীক্ষা করে অগ্নিশুদ্ধ হয়েছিলেন। সবার পক্ষে কেন কারো পক্ষেই গান্ধী হওয়া সম্ভব নয়, তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা, মনোসংযোগ, সাধনা সবারই থাকতে হয়। এ ভাবে  নিজ জীবনের প্রয়োজনেই গান্ধীচর্চা আসতে পারে আমাদের জীবনে।


এই কথা অনস্বীকার্য যে বর্তমান প্রযুক্তি আর বৈদ্যুতিন মাধযমের যুগে ভোগবাদকে একেবারে বাদ দিয়ে জীবন সম্ভব নয়। কিন্তু এই প্রযুক্তি আমাদের মানব সেবার সুযোগ ও বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুন। দরকার কেবল সেই মনস্কতার। সেই মনস্কতা আসতে পারে গান্ধীচর্চা না হোক গান্ধীজিকে জানার আন্তরিক প্রচেষ্টা থাকলেই। আজকের সমাজ গান্ধীজিকে খুব কম জানেন। ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা পাশের জন্য গান্ধীজিকে পড়ে থাকে, অনার্সের জন্য কেউ কেউ হয়তো খানিক বেশি পড়ে থাকে। কিন্তু ছাত্রাবস্থা শেষ হলেই গান্ধীজি বিস্মৃতির অতলে চলে যান।


আমরা ভাগ্যবান মহাত্মা গান্ধী আমাদের পূর্ব পুরুষ। তিনি আমাদের জাতির জনক। আজ সমাজসেবার আড়ালে যখন হয় রাজনীতি, জনসেবার আড়াল জুড়ে থাকে অস্বচ্ছতা আর মুনাফায় তখন গান্ধী জন্ম জয়ন্তীর প্রাক্কালে তাকে স্মরণ করে আত্মশুদ্ধির বড় প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।


তিনি বলতেন,— “ মানুষ যদি সত্য ও অহিংসার সত্যিকারের পূজারি হয় কর্মে যদি নিষ্ঠার অভাব কোনোদিন না হয় তবে তার আহ্বান অপরের চিত্তে সাড়া জাগাবেই। “

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *