অভিজিৎ ঘোষ
***************
“ঘুমন্ত মনুষ্যত্ব আর কবে জাগবে ?
ষড়যন্ত্রের মূল হোতারা পুটলি নিয়ে ভাগছে।”….কবিতার এই পংক্তির সঙ্গে সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় রাজ্য রাজনীতির এক বীভৎস ঘটনার।
সহযুদ্ধাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পৃথিবীকে চির বিদায় জানাতে হয়েছিলো রাজ্যের এক তাবড় রাজনীতিবিদকে। কিন্তু আজও ষড়যন্ত্রের হোতারা আছেন বহাল তবিয়তে। তারা পুটলি নিয়ে ভেগেছে রাজ্যের ক্ষমতার অলিন্দ থেকে। এখন তারাও ইতিহাস।আজও ধলাইয়ের “অভাগা” অভাঙ্গা কাঁদে বিচারের আশায়। গর্জন করে দোষীদের শাস্তির দাবিতে।কিন্তু কমিউনিস্ট শাসনের দীর্ঘ শাসনে প্রয়াত নেতার সহযুদ্ধাদের কর্নকুহনে পৌঁছায়নি ধলাই নদীর জলের তরঙ্গের সঙ্গে ভেসে আসা নিদারুণ আর্তনাদ। সবই যেন বাধা পড়ে গেছে রাজ্য কমিউনিস্টদের ঝুলিতে থাকা লাল খামে।
১৯৯৮ থেকে ২০২২। দীর্ঘ ২৪ বছরে ষড়যন্ত্রকারীরা সবই বিসর্জন দিয়েছে ধলাই নদীর জলে। এখন তারা ক্ষমতা হারিয়ে মন্থ হয়ে বসে আছেন। এমন অবস্থা তারা যেন ভাজা মাছ উল্টাতেও পারেনা। প্রয়াত নেতার স্মৃতিটুকুও যেন তাদের কাছে এখন মূল্যহীন।
ধলাই নদীর তীর অভাঙ্গার ঘটনা সম্পর্কের অজানা নয় রাজ্যের মানুষ।১৯৯৮-র ৩১মার্চ সকাল ১০টায় কি হয়েছিলো অভাঙ্গায়? আজও রাজ্যের জনমনে শিহরণ জাগে সেই দিনের ঘটনায়। অপহৃত ভাই (পালিত) বিক্রম সিনহা এনএলএফটি’র কবল থেকে ছাড়িয়ে আনতে গিয়ে জঙ্গিদের বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন তৎকালীন বাম সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহা। সঙ্গে তাঁর ছোট ভাই বিদ্যুৎ সিনহাও। এই মর্মান্তিক ঘটনার ২৪ বছর পুরণ হলো বৃহস্পতিবার।অর্থাৎ এই রক্তক্ষয়ী ঘটনা পা দিয়েছে ২৫বছরে।কিন্তু আজও অধরা বিমল সিনহা হত্যাকাণ্ডের মূল মাস্টার মাইন্ড।
বিমল সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর রাজ্যের মানুষের চোখে গোলক ধাঁধাঁ লাগানোর জন্য তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার গঠন করেছিলেন “ইউসুফ কমিশন”। ভাগ্যের পরিহাস “ইউসুফ কমিশন” তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করে রাজ্য সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা করেছিলো।কিন্তু মানিক সরকারের নেতৃত্বাধীন বাম সরকার রক্তিম ফিতে দিয়ে বেঁধে রেখে দিয়েছিলো ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট। বা, কি অদ্ভুদ কাণ্ড! সেখানে সহযুদ্ধার খুনিদের কবর খুঁড়ে বের করে আনার কথা,সেখানে তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট রেখে দিয়েছিল হিমঘরে। কার স্বার্থে?কাকে বাঁচাতে? আজও এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি।
পূর্বতন বাম শাসকের দন্ডমুন্ডের কর্তারা তা চেপে গেলেও রাজ্যে মানুষ বুঝে গিয়েছিলো গোটা ষড়যন্ত্র। “ঠাকুর ঘরে কে রে? আমি কলা খায় না”। ঠিক এই অবস্থা হয়েছিলো তৎকালীন শাসক শক্তির “পোস্টার বয়” মানিক সরকারের। বামেদের “ইনার ফাইটে”র কারণেই যে তৎকালীন প্রভাবশালী মন্ত্রী বিমল সিনহার খুন হয়েছিলো, এই চিত্র “অন্তর্ঘাতে”র দর্পণে স্পস্ট হয়ে গিয়েছিলো। মানিক সরকার কেন ইউসুফ কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট চাপা দিয়ে রেখেছিলেন, আজও তিনি এই প্রশ্নের উত্তর দেননি রাজ্যের মানুষকে।এমনকি রাজ্যে থাকা তাঁর অন্যান্য সহযুদ্ধা সহ পলিটব্যুরোকে।তখন মানিকের বিক্রমে সবাই যেন ছিলো নিষ্প্রভ। তাদের বুক ফাটলেও, ফটেনি মুখ।সবাই যেন অসহায়ের মতো কমিউনিস্ট শাসক মানিক সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
তবে রাখে হরি,মারে কে? বর্তমান রাজ্য বিধানসভার মুখ্য সচেতক কল্যাণী রায়ের উচ্চ আদালতে করা জনস্বার্থ মামলার প্রেক্ষিতে প্রকাশ্যে আসে ইউসুফ কমিশনের তদন্ত রিপোর্ট।
“ইউসুফ কমিশনের তদন্ত রিপোর্টে তৎকালীন বাম সরকারের মধ্যমনি তথা মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকারের নানান ভাবে গাফিলতির বিষয়টি উঠে আসে প্রকাশ্যে।”—ইউসুফ কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর ঠিক মানিক সরকারকে তীব্র আক্রমণ করে সরব হয়েছিলেন তদানীন্তন বিরোধী দল নেতা তথা বর্তমান আইনমন্ত্রী রতন লাল নাথ। কিন্তু মানিক সরকার ছিলেন নিশ্চুপ।
প্রাক্তন স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিমল সিনহার হত্যাকাণ্ড—- “বামেদের অন্তর্ঘাতে ফসল”। এই সহজ সত্যটি পরিস্কার হয়ে যায় দলমত নির্বিশেষে সবার কাছেই। ক্ষমতার অহংকারে অহংকারী মানিক সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ মুখে কিছু না বললেও বিমল সিনহার হত্যাকাণ্ডের “মাস্টার মাইন্ডকে” সনাক্ত করে নেয় “জনতার আদালত”।
বিমল সিনহার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত এনএলএফটি’র রক্ত পিপাসু বৈরী মন্টু কলই সহ আরো কয়েকজন আত্মসমর্পণ করেছিল ঘটনার কয়েক বছর পর। অবাক করার মতো ঘটনা তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মানিক সরকার তাঁর সহযুদ্ধার খুনিদের গ্রেফতার না করে তাদের আত্মসমর্পণের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। কার স্বার্থে মানিক সরকার এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন? তদানীন্তন পুলিশ প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত আদালতে তীব্র ভাষায় ভৎসিত হয়েছিলো। আক্ষরিক অর্থে খুনি বৈরীদের গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিমল হত্যাকাণ্ডের ব্লু-প্রিন্ট প্রকাশ্যে চলে আসার সম্ভাবনা ছিলো।এই জন্যই খুনি জঙ্গিদের গ্রেফতার না করে তাদের ঘুর পথে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাঁচিয়ে দিয়েছিল মানিক সরকারের প্রশাসন। এমনটাই বলছেন, অপরাধ বিশ্লেষকরা।
পরিশেষে বলতে হয়, রাজ্য কমিউনিস্টদের নোংরা রাজনীতির বলি বিমল সিনহা। বিমল সিনহার রাজনৈতিক জনপ্রিয়তাই তাঁর সতীর্থদের কাছে ঈর্ষার কারণ হয়ে উঠেছিলো।এই কারণেই তাঁর খুনিদের গ্রেফতার না করে,তাদের আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়াকে বাম সরকার মঞ্জুরি দিয়ে অঘোষিত ভাবে বরণ করে নিয়েছিলো। আজ এটাই ইতিহাসের সাক্ষী। ইতিহাস অবশ্যই কখনো যে ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করে না তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ২০১৮-বিধানসভা নির্বাচন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *